top of page

শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনীতির কচকচি, পড়ুয়াদের কথা আর ভাবছে কে?


তিন বছর আগে মেধাতালিকায় অন্তর্ভুক্ত চাকরিপ্রার্থীরা যখন বিক্ষোভ অবস্থানে বসলেন, সংকটের ইঙ্গিত ছিল সেই দিনই। তবে শাসক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ এই বিক্ষোভ নিয়ে বিশেষ ‘মাথাব্যাথা’-র কারণ খুঁজে পাননি। শাসকদের হয়তো আত্মবিশ্বাস ছিল যে দুর্নীতির নেটওয়ার্ক এতটাই তাগরা যে কেউ এতে দাঁতও ফোটাতে পারবে না। আর অধিকাংশ সাধারণ মানুষ এই বিক্ষোভটিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হিসেবেই ধরে নিয়ে ছিলেন।


বিবেক জাগ্রত হতে শুরু করলো তখনই, যখন উচ্চ-আদালতে এই চাকরিপ্রার্থীদের দাবি নিয়ে মামলা করা হয়। আদালতে বিচারপতির নির্দেশে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বাহিনীকে নিযুক্ত করা হয়। ক্রমশ পেঁয়াজের খোলার মতো দুর্নীতির এক একটি পরত খুলতে থাকে। শিক্ষা দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী থেকে শুরু করে আধিকারিকদের হাজতে বিচারাধীন বন্দি হিসেবে রেখে দেওয়া হয়েছে।


ভারপ্রাপ্ত পদাধিকারীদের যে কীর্তি-কলাপ ফলাও করে গত এক বছর ধরে স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমের শিরোনামে এসেছে তা চিত্তাকর্ষক। কিন্তু তাঁর চেয়েও মর্মবিদারক হল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকারের টানাপোড়েন। একদিকে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় সংবিধানের বিধিনিষেধ ব্যবহার করে রাজ্যপালকে সমান্তরাল প্রশাসন চালাতে দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে, রাজ্য সরকারের তরফ থেকে এই আরোপিত বিধি-বিধান প্রয়োগ বিষয়ে তীব্র অনীহা লক্ষ্যনীয়।


এই পরিস্থিতিতে, অনিচ্ছুক পদাধিকারীদের বিরক্তি, দ্বিধা বা ভয় তাঁদের নেওয়া প্রতিটি পদক্ষেপেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যেমন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংলগ্ন এলাকায় ডেঙ্গি প্রতিরোধের বিষয়ে সদ্য ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যকে প্রশ্ন করা হলে উনি প্রায় মুখঝামটা দেওয়ার মতো করেই প্রশ্নকারীকেই আক্রমণ করলেন এই বলে যে, “সব কিছুই বিশ্ববিদ্যালয়কে দেখতে হবে নাকি?”


অর্থাৎ, বহু-চলিত প্রবাদবাক্যটিকে একটু অন্যভাবে বলা যেতে পারে, শাসকে শাসকে যুদ্ধ হয়, ছাত্রদের প্রাণ যায়’। কয়েকজন অধ্যাপকের সঙ্গে আলাপচারিতার সুত্রে শোনা যাচ্ছে নৈরাশ্যের গভীর সুর। অনেকে এমনও বলছেন যে তাঁরা জানতে পারছেন যে অনেক ছাত্রছাত্রী সরাসরি কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের দপ্তরে এসে আবেদন জানিয়ে যাচ্ছে, যে আমাদের ডিগ্রি বা ডিপ্লোমাগুলি দিয়ে দিন। ক্লাস বা পড়াশোনা তো আর বিশেষ হচ্ছে না। পরীক্ষাও হবে কিনা বুঝতে পারছি না, তাই কেন পড়বো, বলুন?


র‍্যাগিং-এ প্রথম বর্ষের এক ছাত্রের মর্মান্তিক মৃত্যু, এবং তার পরবর্তীকালে নিরাপত্তা ও নজরদারী নিয়ে কূটকচালি শুরু হয়েছে। সেই প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা সিদ্ধান্তহীনতা ছাত্রছাত্রীদের পঠনপাঠনে কি সুরাহা করবে এই মুহূর্তে তা নির্ধারণ করা মুশকিল। তবে আগেকার অভিজ্ঞতা থেকে এটুকুই বলা যায় যে প্রশাসনের এই অতি-সক্রিয়তা শ্লথ হতে বিশেষ সময় লাগবে না। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে বা হোস্টেলে ছাত্রছাত্রীদের প্রবেশ ও প্রস্থানে নজর রাখলেই যে শিক্ষার্থীদের পঠনপাঠনে উন্নতি ঘটবে সাক্ষাৎ দেবী সরস্বতীও এমন আশ্বাস দিতে পারবেন না।


প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্তরেও ছাত্রছাত্রীদের পঠনপাঠনে বিস্তর পরিবর্তন ঘটছে। বিশেষ করে যে বিদ্যালয়গুলি কেন্দ্রীয় শিক্ষাক্রম মেন চলে, তাদের ক্ষেত্রে পাঠ্যপুস্তক থেকে শুরু করে পঠনপদ্ধতি, প্রশ্নপত্র রচনা এবং উত্তরপত্র নিরীক্ষণ প্রক্রিয়ার নিত্যনতুন পরিবর্তনের নির্দেশগুলিতে শিক্ষকরাও যথেষ্ট বিভ্রান্ত। ওনাদের অনেকেই বুঝতে পারছেন না, পরীক্ষা বা পঠনপাঠনের লক্ষ্য পড়ুয়ারা না শিক্ষকরা।


এই বিভ্রান্তির জেরে শ্রেণীকক্ষে যে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক, তা ক্রমশই ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে। ছাত্রছাত্রীদের প্রথমেই বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে শিক্ষা নয়, পরীক্ষায় পাস করাটাই মূল লক্ষ্য। এবং তার চেয়েও যে ব্যাপারটা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে, তা হল বিদ্যালয়গুলিতে একই বিষয়ের শিক্ষকদের মধ্যে পারস্পরিক সমন্বয়ের অভাব। এক শিক্ষকের কথা অনুসরণ করে পরীক্ষা দেওয়ার পরে অন্য শিক্ষক উত্তরপত্রে লাল কালি ঘষে লিখে দিচ্ছেন ‘অপ্রাসঙ্গিক’, ‘অনাবশ্যক’ ইত্যাদি মন্তব্য এবং নম্বরটিও যথারীতি যোগ্যতার তুলনায় কম দিচ্ছেন।


এগুলি ব্যতিক্রমী ঘটনা হলে স্বস্তি পাওয়া যেতো। কিন্তু শিক্ষকদের নিজস্ব বিভ্রান্তি, পরস্পরের প্রতি দ্বেষের পরিণাম ভুগতে হচ্ছে ছাত্রসমাজকেই। সরকারী এবং বেসরকারী বিদ্যালয়গুলির ক্ষেত্রে বাইরে টাকার বিনিময় কোচিং দেওয়ার অনুমোদন না থাকলেও, অভিভাবক, শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকেরা কোচিং ব্যবস্থাটিকে শিক্ষাপ্রদানেরই এক অঙ্গ হিসেবে ধরে নিয়েছেন।


এই ক্ষেত্রে, বলা যেতে পারে কতৃপক্ষ পরোক্ষে বার্তা দিতে চাইছেন যে শিক্ষা গ্রহণ করতে হলে শিক্ষার্থীদের পরিবারকে খরচ করতে হবে। অবিভাবকদের এক শ্রেণীও এই ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট। কারণ, তিনি বা তাঁরা সন্তানদের জন্যে অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে নিশ্চিত হতে চাইছেন ভবিষ্যৎ বলে ওদের কিছু একটা আছে।


যদি তাই ধরে নেওয়া যায়, শিক্ষার্থীরা মাধ্যমিক, উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষাগুলি দিয়ে শিক্ষার সিংহদুয়ার পেরিয়ে কলেজে ঢুকল। এখানে পরিস্থিতি আরও ভয়ানক। বিভিন্ন বিভাগে শিক্ষকের একান্ত অভাব। পার্ট-টাইম লেকচারার হিসেবে যাঁদের ক্লাসে পাঠানো হচ্ছে, শিক্ষাদানের চেয়ে তাঁরা বেশি চিন্তিত যে এত অল্প দক্ষিণার বিনিময় কতটুকু জ্ঞান আমি ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ভাগ করে নেবো।


তবুও এই ‘দিনগত পাপক্ষয়’ করে যারা স্নাতক হলেন, তাদের মধ্যে অবস্থাপন্ন পরিবারের সন্তানেরা ‘সবুজ ঘাসের সন্ধানে’ পশ্চিমমুখী। আর যারা এখানেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অলিন্দে ঘোরাফেরা করছেন, তাঁদের অনেকেই বুঝতে পারছেন না উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে টানাপোড়েনে তাঁদের শিক্ষাগ্রহণে নতুন আর কী মাত্রা যোগ হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনেও যে পরিমাণ মেরুকরণ ঘটছে রাজনৈতিক আদর্শের নিরিখে, তা থেকে ইতিবাচক দিক বিশেষ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।


পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল যদি প্রাক্তন রাজ্যপাল নুরুল হাসানের মতো এক শিক্ষাবিদ হতেন, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ বিষয়ে অতি-সক্রিয়তার একটি অর্থ খুঁজে পাওয়া যেতো। কিন্ত সংবিধান-প্রদত্ত ক্ষমতা ব্যবহার করে যেভাবে উনি বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলির সর্বময় কতৃত্বে বিশেষ এক সংগঠনের সদস্যদের নিয়োগপত্র ধরিয়ে দিচ্ছেন, খেয়ালখুশি মতো রাজ্যপাল ভবনে ডাকছেন বা নির্দেশ দিচ্ছেন, তা এক বৃহৎ ষড়যন্ত্রেরই বার্তা দেয়।


উলটোদিকে, রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকেও যে অনমনীয়তা প্রকাশ পাচ্ছে, তাতে শিক্ষাক্ষেত্রে রাজ্যের স্বাধীনতা দাবির চেয়ে বেশি রাজনৈতিক আধিপত্যের হুংকার গুরুত্ব পাচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্রের ছিদ্রপথ দিয়ে কালসর্পরূপী ক্ষমতাসীন কেন্দ্রীয় সরকারের ছলেবলে প্রবেশ রুখতেই কি এত আয়োজন? উত্তর ‘হ্যাঁ’ হলে সেক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠবে উচ্চশিক্ষায় ইচ্ছুক ছাত্রছাত্রীদেরকে নিজের নিজের দলভুক্ত করাটাই কি আসল লক্ষ্যবিন্দু? বোঝা যাচ্ছে না।


শিক্ষাগ্রহণ এখন যথেষ্ট দামী বস্তু। বলা বাহুল্য, বিশাল একটি উদ্যোগ হিসেবে শিক্ষা দুধকলায় বেড়ে উঠছে দিনেদিনে। বেসরকারি বিদ্যালয়গুলিতে ছাত্রদের মাইনে প্রভৃতিতে একটি ক্যাপ রাখা হলেও ডোনেশন বা ডেভেলপমেন্ট খাতে বেশ বড় টাকাই হাতবদল হয় এই শিক্ষারূপী ক্রুর ব্যবসাকেন্দ্রগুলিতে। সবাই জানে, কিন্তু কেউ কিছুই জানে না।


দুই দশক আগে প্রস্তাব এসেছিল যে আইএএস, আইপিএস, আইএফএস প্রভৃতি কেন্দ্রীয় নিয়োগ প্রতিষ্ঠানের মতো আইটিএস অর্থাৎ, ইন্ডিয়ান টিচার্স সার্ভিস তৈরি করা হোক। এই প্রস্তাব ক্ষমতাসীন বা পরবর্তী সরকার গ্রহণ করেনি। কারণটি হয়তো বা এই, মধ্যপ্রদেশে ব্যাপম বা পশ্চিমবঙ্গে টেট এবং নিয়োগ সংক্রান্ত অব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল যাতে মোটা অঙ্কের টাকা তাদের তহবিলে সংগ্রহ করতে পারে।


ছাত্রছাত্রীদের যে শিক্ষা প্রদান করা হচ্ছে সেখানে শিক্ষাপদ্ধতির সমন্বয়ের যথেষ্ট অভাব। সংশ্লিষ্ট শিক্ষক মহলে চিন্তিত কেউ কেউ যে তা লক্ষ্য করছেন না এমনটা নয়। সম্ভবত সরকারও করছে। কিন্তু শিক্ষা সবার অধিকার বা সর্বশিক্ষার যে প্রচারকেন্দ্রিকতা, সেখানে আজও মিড-ডে মিলের দৈনিক হিসাবটা মেলানোই প্রাথমিক লক্ষ্য। লক্ষ্য হিসেবে শিক্ষাদানই যেখানে গৌণ, সেখানে তরুণ প্রজন্মের অবনমন নিয়ে আক্ষেপ করার কি কোনো অর্থ আর থাকে?

Comments


bottom of page