top of page

কফি হাউসের সেই আড্ডাটা যেখানে সত্যিই আর নেই, সেখানে ক্যাফে কালচার হবে কী?


আড্ডা শব্দটি একান্তভাবেই বাঙালির। আর এই আড্ডা জমে ওঠার এক প্রধান স্থল শহর, শহরতলী এবং গ্রামের চায়ের দোকানগুলি। তবে কফিহাউস বললেই বাঙালির এক অন্য অনুভূতি তৈরি হয়। বিশেষ করে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউস এবং যাদবপুরের কফি হাউস।


কত ম্যাগাজিনের জন্ম এবং লালন-পালন যে কফি হাউসেই হয়েছে, তার হিসেবে এখন মৌখিক ইতিহাস। আড্ডা, ইনফিউশনের কড়া গন্ধ, সিগারেটে কত যে ভাবনা চালাচালি হয়েছে এই দুই কফিহাউসে, তা লিখে রাখলে বাঙালি বুদ্ধিচর্চার গৌরবজনক অধ্যায়গুলি বিশ্ববাসীর জন্যে, আগামী প্রজন্মের বাঙালির জন্যে রয়ে যেতো।


আগের প্রজন্মে যারা বাঙালি, তাঁদের পকেট ছিল ফাঁকা, মাথা কিন্ত ছিল স্বপ্ন আর ভাবনায় ভর্তি। চা বা কফির কাপে চুমুক দিয়েই সেই ভাবনার আদান-প্রদান চলতো নির্বিঘ্নেই। এখন কিন্তু আর তার উপায় নেই। অথবা আছে, তাঁদেরই জন্যে, যাঁদের মাথা খালি হলেও পকেট কিন্তু ভর্তি।


এবার কফিহাউস কি শুধু সেই ভারি পকেটওয়ালাদেরই স্বাগতম জানাবে? সাম্প্রতিক লক্ষণগুলি সেদিকেই ইঙ্গিত করছে। অন্তত যাদবপুর কফিহাউস কতৃপক্ষের ভাবগতিক তেমনটাই।


যাদবপুর কফি হাউস যাদের পরিচালনাধীন, সেই ইন্ডিয়ান কফি ওয়ার্কার্স অ্যাসোসিয়েশন আজ রবিবার গ্রাহকদের জন্যে কফিহাউসের দরজা খুলে দিলেন। গত এক সপ্তাহ ধরে বন্ধ ছিল যাদবপুর কফি হাউসের দরজা।


এই যে এক সপ্তাহ বন্ধ হয়ে ছিল যাদবপুর কফি হাউস, তা এক বড় বিচিত্র কারণে। কফিহাউসে বসে গ্রাহকদের ল্যাপটপ ব্যবহার বরদাস্ত হচ্ছিল না কফিহাউস কতৃপক্ষের। এক সপ্তাহ আগে রীতিমতো ধমক দিয়ে ভয় দেখিয়ে গ্রাহকদের ল্যাপটপ ব্যবহার বন্ধ করেন কফিহাউসের কর্মীরা।


এই বিচিত্র নিষেধের প্রতিবাদ করেন ক্ষুব্ধ গ্রাহকেরা। এবং গ্রাহকদের সেই ক্ষোভের বিস্ফোরণের প্রতিক্রিয়ায় কফিহাউসের দরজা এক সপ্তাহের জন্যে বন্ধ করে দেন কতৃপক্ষ।


গতকাল, শনিবার কফিহাউসের দরজা খুলল বটে। তবে গ্রাহকরা আবিষ্কার করলেন কতৃপক্ষ শুধু তাঁদের ল্যাপটপের ব্যবহারের বিরুদ্ধে অনড়ই নন। বরং এবারে তাঁরা শিবঠাকুরের আপন দেশের সর্বনেশে আইন মাথায় রেখে, নতুন আরেকটি নিষেধাজ্ঞাও জারি করেছেন।


ওনাদের বক্তব্য, যে কফিহাউসে বসে কোনো রকম ‘কমার্শিয়াল ওয়ার্ক’ করতে পারবেন না গ্রাহকেরা। এই নোটিশটির পড়বার পরে স্বাভাবিক ভাবে দুটি প্রশ্ন উঠতে পারেঃ


এক, কফিহাউসে বসে ‘কমার্শিয়াল ওয়ার্ক’ বলতে কী বোঝাতে চাইছেন অনড় কতৃপক্ষ?দুই, গ্রাহকদের একসঙ্গে বসে কফির কাপে চুমুক দিয়ে কথার আদান-প্রদান থেকে কতৃপক্ষ কীভাবেই বা বুঝবেন যে গ্রাহকেরা কফিহাউসে বসে ‘কমার্শিয়াল ওয়ার্ক’ করছেন?


প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজতে বসে দুটি কথা অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবেই আসবে। এক, গ্রাহকদের উপরে কড়া নজরদারী চালাবার উদ্যোগ নিয়েছেন কফিহাউসের কতৃপক্ষ। এবং দুই, স্বল্প মুল্যে কফি বা স্ন্যাক্সের বিনিময়ে কফি হাউসের চেয়ারগুলি গ্রাহকদের অধিকারে রাখতে দিতে কতৃপক্ষের স্পষ্ট আপত্তি আছে।


কলকাতার মানুষদের আড্ডার একটি বিশিষ্ট দিক এর গঠনমূলক প্রবণতা। প্রতিটি আড্ডাতেই সম-মনস্ক মানুষেরা কোনো একটি ধারনার বিস্তৃতি চেয়েছেন, সেই ধারণাকে সাহিত্যে বা চলচ্চিত্রে পরিণত করবার প্রয়াস পেয়েছেন।


শিল্পী, কবি এবং চলচ্চিত্রকার পূর্ণেন্দু পত্রীর কথাই ধরা যাক না। ১৯৭২ সালে যখন তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট গল্প অবলম্বনে ‘স্ত্রীর পত্র’কে চলচ্চিত্রে পরিণত করবার কথা ভাবেন, কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসে বন্ধুদের মাঝে বসেই তিনি ছবির গোটা চিত্রনাট্য রচনা করেন।


পঞ্চাশ বছর বাদে কফিহাউস কতৃপক্ষের মনে হতেই পারে পূর্ণেন্দু পত্রীর মতো মানুষ ‘কমার্শিয়াল ওয়ার্ক’ করছেন। কিন্তু যদি বা তিনি তাইই করেন, বা তাঁর উদাহরণে আর কেউ তা আজ করতে চান, তাতে কফিহাউসের কতৃপক্ষের গাত্রদাহ কেন?


মুম্বাই শহরে থাকাকালীন বিভিন্ন ইরানী হোটেলে কাটিং চা খেয়েছি বন্ধুদের সঙ্গে। চায়ের কাপ শেষ হওয়ার পরে একটু বেশি সময় বন্ধুর সঙ্গে গল্প করলেই দেখেছি ওয়েটার অধৈর্য হয়ে আম্মাদের পরের অর্ডার জানতে চাইছে। দিল্লীতে তো আরও খারাপ ব্যবহার পেয়েছি। পরটা আর কাবাবের প্লেট শেষ হয়ে গেলে বসে থাকলে মালিক্রা হাঁক মেরে জায়গা খালি করে দিতে বলতেন। চেন্নাই বা বেঙ্গালুরুতেও রেস্তোরার মালিকদের সঙ্গে গ্রাহকদের সম্পর্ক নিছক ব্যবসায়িক – খাও, বিলের টাকা দাও আর ভাগো। গর্ব অনুভব হতো যে কলকাতা এমন পাষাণ শহর নয়।


কিন্তু আজ কলকাতাও বাকি মেট্রো শহরগুলির মতোই বড় কৃপণ। দোকানে একটা চেয়ার বা বেঞ্চে বসা, গলাটা একটু ভিজিয়ে নেওয়া, বা স্বল্পমুল্যে ভাজাভুজি কিছু খাওয়া বা রোদ বা বৃষ্টি থেকে একত্রিত হওয়া বন্ধুদের কিছুক্ষণের জন্যে মাথার উপরে ছাদটুকু দিতেও আমার শহরের এখন অনীহা। বন্ধু-বান্ধব বা সহকর্মীদের সঙ্গে বাড়ির বাইরে সাক্ষাৎ করলে, চিন্তার আদান-প্রদানে একটুকু পরিসর আমার শহর আর দেবে না।


বোঝা যাচ্ছে, কতৃপক্ষেরা যাদবপুরে এখন কফিহাউস নয়, ক্যাফে চালাতে চাইছেন। কারণ, ‘ক্যাফে কালচার ইজ দ্য ইন থিং’। যে সংস্কৃতিতে বর্তমান এক কাপ কফির মুল্যের তিরিশ, পঞ্চাশ বা একশো গুণ বেশি টাকা চাইলেও, তা দিতে অনেক গ্রাহকদের ভ্রূ-জোড়া কোঁচকায় না।


কিন্তু যাদবপুর কফিহাউসের যে বর্তমান ভৌগলিক অবস্থান, অর্থাৎ একটি কমপ্লেক্সের দোতলা, সেখান থেকে ইন্ডিয়ান কফি ওয়ার্কার্স অ্যাসোসিয়েশন কি স্থানীয় মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধবিত্ত উৎসাহী মানুষদের আকর্ষণ করতে পারবে?

Comments


bottom of page