প্রথমেই বলে নেওয়া উচিৎ যে ধর্ম একান্তভাবেই ব্যক্তিগত বিষয়। জনসমক্ষে তার প্রচারে উদযাপন হয় ঠিকই, তবে ধর্ম পালন কতটা হয়, তা তর্কের বিষয়।
কথাটি এই কারণে মনে করতে হচ্ছে, যে সম্প্রতি তামিলনাডু সরকারের যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রী উদয়নিধি স্টালিন ‘সনাতন ধর্ম’ নিয়ে কিছু তির্যক মন্তব্য করেছিলেন। উনি ‘ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, জ্বর এবং করোনা অতিমারি’-র সঙ্গে তুলনা করেছেন সনাতন ধর্মকে।
মন্ত্রীসভার এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী স্বয়ং সভাপতি হিসেবে উপস্থিত হয়ে মন্ত্রীদের নির্দেশ দেন যে উদয়নিধি স্টালিনের এমন বক্তব্যের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক প্রতিরোধ করতে হবে। এর পাশাপাশি তিনি তাঁর মন্ত্রীদের বলেন যে বিরোধীরা যে সনাতন ধর্মের আখ্যান তৈরি করেছেন, তার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে।
উগ্র জাতীয়তাবাদের যে দীর্ঘ পরম্পরা স্বাধীনতা-পূর্ব এবং স্বাধীনোত্তর ভারতে চলে এসেছে, সেখানে ‘সনাতন ধর্ম’ নামের শিকড় যে গভীরে চারিয়ে গেছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তার এমন সোচ্চার প্রকাশ ইদানিং ভারতীয় সমাজের একটি স্বাভাবিক লক্ষণ বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে।
এই প্রসঙ্গে আরেকবার উল্লেখ করে নেওয়া যাক যে ধর্ম একান্তভাবেই ব্যক্তিগত এক অনুভূতি, যার সঙ্গে ব্যক্তিমানুষের আস্থা ও তাঁর রীতি-আচরণ গভীরভাবে সম্পৃক্ত। কিন্তু ব্যক্তিমানুষের এই অনুভুতিকেই যখন একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিচিতি দিয়ে চিহ্নিত করা হয়, তখন ভারতবর্ষ যে বহুত্ববাদী সত্ত্বাকেও ঐতিহাসিক কাল থেকে বহন করে আসছে, সেই সত্ত্বাকেই অস্বীকার করা হয়।
‘সনাতন’ শব্দটিকে বিজেপি একটি ধ্রুবকের মতো ব্যবহার করছে এখন। যার সঙ্গে দেশ বা কালের পরিবর্তনশীলতার যেন কোনো সম্পর্কই নেই। যেমন, ধরা যাক চন্দ্রযান ৩ বা আদিত্যযান এল ১-এর উৎক্ষেপণের আগে সংস্থার বৈজ্ঞানিক ও গবেষকবৃন্দ ঈশ্বরের কাছে সাফল্যের জন্যে প্রার্থনা করেছেন।
লক্ষ্যনীয় যে, এই ব্যক্তিগত আবেগকে ঘটা করে বিজ্ঞাপিত করা হয়। যার মধ্যে দিয়ে এই ব্যক্তিদের বিজ্ঞানের প্রতি নিষ্ঠা এবং নিরন্তর প্রয়াসকেই গৌণ করবার সচেতন প্রয়াস প্রকট। ভাবখানা এই, যেন, বিজ্ঞানের প্রতি নিষ্ঠা এবং নিরন্তর প্রয়াস শুধুমাত্র তাঁদের চাকরির আবশ্যিক শর্তাবলীর অন্তর্গত বিষয় মাত্র। তাঁদের মেধা এবং পরীক্ষা চালিয়ে যাওয়ার কঠিন ধৈর্যশীলতার উপরে ঈশ্বরের প্রতি আস্থাকে যথেষ্ট উপরে স্থান দেওয়া হচ্ছে।
রাষ্ট্রের এই ধর্মবোধ নতুন প্রজন্মের কাছে যে বার্তাটি পৌঁছাচ্ছে, তা কিন্তু আধুনিক যুক্তিবাদী
পরম্পরার সম্পূর্ণ বিপরীত। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যেন তরুণ ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে মেধা সহযোগে তারা যে শিক্ষা অর্জন করে তা বৃথা যাবে যদি না তোমার ঈশ্বরের প্রতি আস্থা থাকে। ভবিষ্যতে বিজ্ঞানসাধনায় রত হওয়ার যে স্বপ্ন তারা দেখছে, তা কখনোই পূরণ হবে না যতক্ষণ না তারা ধর্মের অধীন হবে।
এই যে সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পর্ব, তার ইতিবাচক দিকগুলির অধিকাংশ ব্যাখাসাপেক্ষ। এবং আদৌ যদি এর পক্ষে কেউ ব্যাখা প্রস্তুত করেন, তাহলে তাঁকে প্রমানের চেয়ে অনেক বেশি আবেগের শরণাপন্ন হতে হবে – হয় সে ভক্তির মর্মবাণী বা মহাজনেদের উক্তি প্রয়োগে মগজধোলাই করবেন, নয়তো রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে নত হতে বাধ্য করে।
শিক্ষার ক্ষেত্রে যুক্তি ও মেধার চেয়েও রাষ্ট্র যদি ‘সনাতন’ কিছু ধ্যান-ধারণার অনুসরণকে অগ্রাধিকার দেয়, তাহলে দেশের আদৌ অগ্রগতি হবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ রয়েই যায়। এবং তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার রয়েছে। সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলিতে যে একের পর এক অবক্ষয়গুলো গত সাত-আট বছরে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তা নিয়ে কোনো বিতর্কের অবতারনা করলেই ধর্মভিত্তিক প্রসঙ্গ তুলে তা স্তব্ধ করবার প্রবণতা বেড়েই চলেছে।
মূল প্রশ্নটি কিন্তু রয়েই যাচ্ছে। সংখ্যাধিক্যের পালিত ধর্ম বাঁচালেই কি দেশ বাঁচবে? প্রশ্নটিকে এড়িয়ে যদি ‘সব কা সাথ সব কা বিকাশ’-এর কথা বলা হয়, সেই শূন্যগর্ভ আস্ফালন দিয়ে আসন্ন নির্বাচনের তরী কি পার করা যাবে?
Comments