top of page

প্রধানমন্ত্রী, এবার কৃষকদের অবস্থা আর ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনার সরকারের ভাবনাটুকু অন্তত জানান



মুকুল দত্তের লেখা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে ও কণ্ঠে ‘মণিহার’ ছবির একটি জনপ্রিয় গানের প্রথম স্তবক মনে পড়ছেঃ ‘সব কথা বলা হলো, বাকি রয়ে গেল শুধু বলিতে”। ভারতবর্ষের কৃষক পরিচয়ে বাঁচার যে কী জ্বালা, তা গত নয় বছরে গ্রামের মানুষ বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছে। প্রধানমন্ত্রীকে দেশে বিদেশে অর্থনৈতিক উন্নতি নিয়ে বড় বড় কথা বলতে শোনা গেছে। কিন্তু কৃষকদের প্রসঙ্গে তিনি বেশ কিছুকাল নীরব। কেন যে উনি শেষ প্রহরে পৌঁছে পিছু ফিরে কৃষকদের উদ্দেশ্যে 'মন কি বাত' শোনাচ্ছেন না, তার ইঙ্গিত দেশের পক্ষে আদৌ শুভ নয়।


এই নীরবতা এই কারণে উল্লেখযোগ্য যে ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অত্যন্ত জোর গলায় আশ্বাস দিয়েছিলেন যে ২০২২ সালের মধ্যে ভারতের কৃষকদের আয় দ্বিগুণ হয়ে যাবে। নরেন্দ্র মোদী সহ বিজেপি-র নেতারা গত বছর অবধি বোঝাতে চেয়েছেন যে কৃষকদের দ্বিগুণ আয়ের ব্যবস্থা তো আমরা করেই ফেলে ছিলাম। কিন্তু এই কোভিড অতিমারির কারণে সর্বনাশ হয়ে গেল। দাবিটি যে আদ্যোপান্ত মিথ্যা, তা বুঝতে বিশেষ মাথা ঘামাতে হবে না।

২০১৭ থেকে ২০১৯ অবধি যে আর্থিক মন্দার মধ্যে দিয়ে ভারতের সাধারণ মানুষদের ভুগতে হয়েছে, তার মধ্যে কৃষকেরাও ছিলেন। বিশেষ করে নোটবন্দির কারণে এবং অনলাইন পেমেন্টের চক্করে যে কত কৃষক সর্বস্বান্ত হয়েছেন, তা আলাদা করে হিসেব সম্ভবত আর পাওয়া যাবে না।


তবে ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরো’র বাৎসরিক পরিসংখ্যানে যে আত্মঘাতীদের হিসেব রয়েছে, তার একটা বড় অংশই কৃষক ছিলেন। ক্ষেতে ফলন হওয়া সত্ত্বেও তা বিক্রির জটিলতার কারণে বাৎসরিক ঋণ শোধ না করতে পেরে তাঁদের অনেককেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন।


সেই ছোটবেলা থেকে ভারতের মানুষ জেনে এসেছেন যে ভারত কৃষিপ্রধান দেশ। লালবাহাদুর শাস্ত্রী স্লোগানও দিয়েছিলেন, ‘জয় জওয়ান, জয় কিসান’।


সেই কিষানদেরই কোভিড অতিমারির মধ্যে দেশের রাজধানীতেই প্রতিবাদ বিক্ষোভে অবস্থান করতে দেখা গেছে দলে দলে। ট্র্যাক্টর করে তাঁদের এই প্রতিবাদ যাত্রা যাতে দিল্লীর কেন্দ্র অবধি না পৌঁছাতে পারে, সেই জন্যে রাস্তা কেটে দেওয়া হয়েছে, ইস্পাতের বেড়া বসানো হয়েছে, দেশদ্রোহী বা আতঙ্কবাদী বলে দেগে দেওয়া হয়েছে।


কারণ, ন্যুনতম সহায়ক মূল্য স্থির করবার জন্যে সরকারকে আবেদনের পর আবেদন জানিয়ে কাজ না হওয়ায় ক্ষেতখামারি ছেড়ে রাস্তায় নেমে রাস্তাতেই দিনের পর দিন কাটাতে হয়েছে তাঁদের।


কী চাইছেন ভারতের কৃষকেরা? চাইছেন কৃষিঋণ মকুবের ঘোষণা, বিদ্যুৎ, ডিজেল, সার, কীটনাশক ইত্যাদি অতি-প্রয়োজনীয় জিনিসে সরকারী ভর্তুকি, ফসল বিমার আশ্বাস। এই চাহিদার পিছনে যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে। আর্থিক মন্দার কারণে যে পরিমাণে মূল্যবৃদ্ধি ঘটছে, তার সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ছে কৃষকদেরই উপর।


চাষ তাঁদের করতেই হবে। কিন্তু সেই চাষের জন্য বীজ, সার, বিদ্যুৎ ইত্যাদির মূল্য চোকানোর সামর্থ্য অধিকাংশ কৃষকদেরই নেই। অতএব, তাঁদের ঋণ করেই চাষ করতে হবে। এর উপরে রয়েছে খরা বা অতিবৃষ্টির সম্ভাবনা, যা ঘটলে সম্পূর্ণ মরসুমটাই বিফলে যায় তাঁদের। অথচ, যে সরকার কৃষিবন্ধু সেজে পর পর দুইবার ভোট কাটাকুটি করে জিতে প্রধানমন্ত্রীর পদটি কায়েম রাখলো, সেই সরকারই প্রয়োজনে তাঁদের পাশে নেই।


সরল মানুষরা জানতে চাইলেও পারেন যে প্রতিটি জিনিসের মতো চাল, গম, ডাল এবং অন্যান্য ফসলের দাম নিত্যনৈমিত্তিক বেড়েই চলেছে। এই বর্ধিত মূল্য থেকে কি কৃষকদের ঘরে কিছু টাকা ঢুকছে না।


না, ঢুকছে না। কারণ, পাইকারি বাজার বা মাণ্ডীতে কৃষকেরা ফসল বিক্রি করেন প্রতিযোগিতামূলক দামে। সেই ফসল গুদামজাত করে সম্পূর্ণ লাভটি ঘরে নিয়ে যায় মধ্যস্বত্বভোগীরা। জমির সঙ্গে যাদের দুরদুরাস্তে সম্পর্কই নেই। গৌতম আদানি এমনই এক মধ্যস্বত্বভোগী।


রাহুল গান্ধী অভিযোগ করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে এই মধ্যস্বত্বভোগী গৌতম আদানির ঘনিষ্ঠ যোগ রয়েছে। এই অভিযোগের বিরুদ্ধে সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী এমন কিছু বলেননি, যাতে আইনত প্রতিষ্ঠিত হয় যে রাহুল গান্ধীর অভিযোগ মিথ্যা।


সাধারণ মানুষ উপলব্ধি করছেন যে মিথ্যা প্রতিশ্রুতির ভারে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং ডুবতে বসেছেন। নিজের ’৫৬ ইঞ্চির ছাতি’ ফুলিয়ে দেশবিদেশে প্রচারের ঢেউ তুলছেন তুলুন। কিন্তু দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড এই কৃষকদের অস্তিত্বটাই কি ভোট ‘জেতা’-র নেশায় ভুলে গেছেন?

Comments


bottom of page