ঘটা করে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন সমাপ্ত হলো রবিবারে। প্রচারের প্রায় সব আলো শুষে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সভাপতির আসন অলংকৃত করে শোনালেন তাত্ত্বিক কিছু কথা। বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকও করলেন।
রাষ্ট্রপতি ভবনে নৈশভোজ সারবার আগে বিশ্ববাসীকে জানিয়েও দিলেন মোদী যে আগামী নভেম্বর মাসে আনুষ্ঠানিক ভাবে সভাপতির দায়িত্বের প্রতীক কাঠের হাতুড়ি ব্রাজ়িলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভার হাতে তুলে দেওয়ার আগে উনি আরেকটি ভার্চুয়াল সম্মেলনের সভাপতিত্ব করতে উৎসুক।
আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রীর পরিবর্তে ‘নরেন্দ্র মোদী’ নামটি বারবার ঝলসে উঠছে সংবাদ মাধ্যমগুলিতে। কিন্তু জি-২০-র সভাপতিত্বে নরেন্দ্র মোদী নয়, আমাদের দেশ আসীন। অথচ, সম্মেলন-কেন্দ্রিক যত সংবাদ প্রচারিত হয়েছে, সেখানে নরেন্দ্র মোদী নামটিই সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করেছে।
প্রশ্ন হলো, জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন নিয়ে মাতামাতি করে ইন্ডিয়া তথা ভারতের কপাল খুলবে কি? প্রগতি ময়দানে ভারত মণ্ডপমের সভাস্থল যতই জাঁকজমকে সেজে উঠুক না কেন, জি-২০’তে ভারতের উন্নতিতে বিশেষ ছাপ পড়বার সম্ভাবনা কমই। এই কথাটি কেন সর্বাগ্রে চলে আসছ?
১৯৯৯ সালে পৃথিবীর কুড়িটি সর্ববৃহৎ অর্থনীতির এক সমাবেশ একত্রে বসে আন্তর্জাতিক অর্থনীতি এবং অর্থকরী বিষয়াবলী নিয়ে স্থিতিশীলতা বজায় রাখবার লক্ষ্যে প্রতি বছর মিলিত হয়। এই দেশগুলি হলো, আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, কানাডা, চীন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ই.উ.), জার্মানি, ফ্রান্স, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ইটালি, জাপা্ মেক্সিকো, রাশিয়া, সৌদি আরব, দক্ষিণ কোরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, টার্কি, ইউনাইটেড কিংডম এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। স্পেন চিরকালীন অতিথির ক্ষমতাবলে অংশগ্রহণ করতে পারে।
জি-২০তে ভারতের সভাপতিত্বের পর্ব শুরু হয় ২০২২-এর ডিসেম্বরে এবং আগামী নভেম্বর ২০২৩ অবধি তা চলবে। ক্ষমতাসীন বিজেপি মরিয়া হয়ে এই সভাপতিত্বকে তার ব্যক্তিগত অর্জন হিসেবে জাহির করতে চাইছে। দলের চিহ্ন (একই সঙ্গে ভারতের জাতীয় ফুল) হিসেবে পদ্মফুলকে জি-২০র প্রতীক চিহ্নে বিন্যস্ত করতে উন্মুখ। এর থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে জি-২০কে বিজেপি গ্রাস করে নিতে চাইছে।
২০২২-এ ইন্দোনেশিয়ার থেকে ভারতের হাতে সভাপতিত্বের ভার নেওয়ার সময়ে নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, ‘আবহাওয়া পরিবর্তন, আতঙ্কবাদ এবং অতিমারির যে চ্যালেঞ্জগুলি আমাদের সামনে রয়েছে, তা একে অপরের সঙ্গে লড়াই করে নয়, এক অপরের সহযোগে যুঝতে হবে’।
অথচ মজার কথা হলো, ২০১৮ সালে ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) ঘোষণা করেছিল যে ২০৫০ সাল নাগাদ পৃথিবী নেট জিরো পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে যদি তা প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী উষ্ণায়নের মাত্রাটিকে ১.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের লক্ষ্যে বেঁধে রাখতে পারে। এই চুক্তিতে ভারত এবং চীন এই প্যাক্টে স্বাক্ষর করেনি। উল্টে দুই দেশই চেয়েছে ডেডলাইনটিকে ২০৫০ সাল থেকে পিছিয়ে ২০৭০ সাল করা হোক, কারণ ততদিন অবধি পর্যায়ক্রমে কয়লা ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করা সম্ভব হবে না। এবারে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী কিন্তু এই প্রসঙ্গটিই অবলীলায় এড়িয়ে গেলেন।
আশ্চর্যের বিষয়, জি-২০র একটি লক্ষ্য ছিল শ্রম অধিকার এবং কৃষি! মনে রাখতে হবে এই সেই দেশ যে হাতে গোনা কয়েকটি সুবিধাবাদী, লোভী মানুষদের সুবিধার্থে শ্রমিক আইন বদলে দেয় এই অজুহাতে যে অতিমারির মধ্যেও বিনিয়োগকে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। দীর্ঘ এক বছর ধরে সেই কৃষকেরা যখন প্রতিবাদ ো বিক্ষোভ জানিয়ে মৃত্যুরও সম্মুখীন হন, তখনও ‘গোদী’ মিডিয়া, বিজেপির মন্ত্রীসমূহ সহ বিজেপির আইটি স তাঁদের লাঞ্ছনা, অবমাননা, এমনকি ষড়যন্ত্রও কৃষক আন্দোলনকে স্তব্ধ করবার নানা ফন্দি-ফিকির খেজে গেছে।
সম্মেলনের প্রস্তুতি বৈঠকে ভারত জানায় যে দেশে তথা বিশ্বে কোভিড অতিমারির কী অভিঘাত ঘটলো, তা নিয়ে বিশেষ নিরীক্ষণ চালাবে। এই কথা যখন ঘোষিত হচ্ছে, অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিরা নিশ্চয়ই মুচকি হেসেছিলেন। কারণ অতিমারির বিরুদ্ধে ভারত সরকারের যে সক্রিয়তা ছিল, তা বিশ্বের অন্য দেশগুলি জুড়ে যে গড় মাত্রা তৈরি হতেছি, সেই সংখ্যার চেয়ে অনেকটা নিচুতে।
প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসে নরেন্দ্র মোদী ভাবতেই পারেন যে উনি মূর্খদের শাসন করছেন। মূর্খ এই কারণে যে প্রচার-সর্বস্বতার চোখ ধাঁধানো কৌশলেই তিনি বাজিমাত করে এসেছেন। এবং বিশ্বাস করেন এই পদ্ধতিতে পরবর্তী দিনে উনি বাজি মাত করতে পারবেন। বিরোধিতার কণ্ঠ খণ্ড খণ্ড করে শাসন টিকিয়ে রাখবার এই কৌশল এতদিন কাজ করেছে বলে যে সবসময়ই কাজ করবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই।
নির্বাচন সমুদ্র অতিক্রম করতে প্রথমে উনি খড়কুটোর মতো প্রথমে ‘এক দেশ এক ভোট’-এর হিড়িক তুললেন, এবং তারপরেই চাইলেন নভেম্বর মাসে দায়িত্বভার শেষের আগে উনি কামাল দেখাবেন। অসুবিধা একটাই, দুঁদে খেলোয়াড় হলেও উনি হাতের সব তাসই জনসাধারণকে দেখিয়ে দিয়েছেন। জনসাধারণ তা দেখেছে কিনা, তা সময়ই বলবে।
コメント