মোটামুটি ১৭ শতাব্দী থেকেই রাষ্ট্রদ্রোহ অপরাধটি আধুনিক বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কারণ প্রত্যেক রাষ্ট্রপ্রধান চেয়েছে জনসাধারণ শুধু তাঁদের প্রশংসা করুক, সমালোচনা নয়। ১৮৩৭ সালে টমাস ব্যবিংটন ম্যাকোলে ভারতের জন্যে প্রযোজ্য রাষ্ট্রদ্রোহ আইনটি প্রণয়ন করে।
তারপরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে রানি ভিক্টোরিয়া শাসনভার নেন। এবং তার প্রায় দুশো বছর পরে ভারত যখন স্বাধীনতা অর্জন করে, তখনও রাষ্ট্রদ্রোহ আইনটিকে বলবত রেখে দেয়।
স্বাধীন গণতান্ত্রিক এক দেশে রাষ্ট্রদ্রোহ বিষয়টি কেন ভারতীয় দণ্ডবিধিতে রেখে দেওয়া হবে, তা নিয়ে নানা সময়ে বিতর্ক হয়েছে। বস্তুত, এই ১২৪(এ) ধারাটি ভারতীয় সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হলো, তা নিয়ে কম ঝড় ওঠেনি। কারণ, স্বাধীন দেশবাসীর বাক-স্বাধীনতার ধারনার মুলেতেই আঘাত করে এই রাষ্ট্রদ্রোহ বিশ্যের আইন।
এর আগে ১৯৭৫ সালে যখন ভারতে জরুরি অবস্থা লাগু করা হয়, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, এই রাষ্ট্রদ্রোহ বিষয়ক আইনটিকে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করে বিরোধী কণ্ঠস্বরকে সোচ্চার হতে দেন না। সংবাদপত্রের স্বাধীনতাটুকুও ছিনিয়ে নেওয়া হয় এই আইনের বলে।
আশ্চর্যের বিষয়, সেই সময়ে জয়প্রকাশ নারায়ন, অটলবিহারী বাজপেয়ী, লালকৃষ্ণ আদবানি সহ বিভিন্ন বিরোধী নেতাদের এই রাষ্ট্রদ্রোহ আইনেই কারাবাস করতে হয়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এক রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সমিতির কর্মী হিসেবে সেই সময়ে আত্মগোপন করেছিলেন এই আইনের প্রকোপ থেকে বাঁচতে। অথচ, নিজে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে, এই রাষ্ট্রদ্রোহ আইনটি প্রয়োগ করবার বিষয়ে তাঁর যথেষ্ট উৎসাহ এবং উদ্দীপনা।
কী প্রমাণ করতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী? অথবা, প্রশ্নটা এভাবেও করা যায় যে তাঁকে এবং তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও সমালোচনার মুখগুলি বন্ধ করলেই তিনি কি নিজের শাসনপ্রণালী আরও অনেকদিন কায়েম রাখতে পারবেন? মাথায় রাখতে হবে যে গত বছর মে মাসে শীর্ষ আদালতে কেন্দ্রের তরফে জানানো হয়েছিল, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের ধারা এবং সাজার বিধানগুলি পুনর্বিবেচনা করা হচ্ছে। সেই হিসেবে সুপ্রিম কোর্ট থেকে এই আইনটিকে স্থগিত রাখে।
কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে দাঁড়ানো অ্যাটর্নি জেনারেল আর ভেঙ্কটরমানি আগের শুনানিতে শীর্ষ আদালতকে জানিয়েছিলেন, ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪ ধারা-সহ রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের আওতায় থাকা বিভিন্ন ধারাগুলি পরীক্ষা করার কাজ শুরু করেছে কেন্দ্র। সেই প্রক্রিয়া এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
অথচ সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণে এসেছে যে স্থগিত করা আইনটি ব্রিটিশ জমানার রাষ্ট্রদ্রোহ আইন খোলনলচে বদলে আবার চালু করতে সক্রিয় হয়েছে নরেন্দ্র মোদী সরকার।
এই পরিস্থিতিতে বিষয়টি বিবেচনার জন্য সংবিধান বেঞ্চে পাঠাল শীর্ষ আদালত।
কেন্দ্রের তরফে এ বিষয়ে শুনানি পিছিয়ে দেওয়ার আবেদন জানানো হলেও প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন তিন বিচারপতির বেঞ্চ তা খারিজ করে দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট থেকে জানানো হয়েছে যে, অন্তত পাঁচ বিচারপতিকে নিয়ে গঠিত সংবিধান বেঞ্চ বিষয়টির সাংবিধানিক বৈধতা যাচাই করবে।
Comments