১০ সেপ্টেম্বর, ১৯১৩। সুকুমার রায় অকালে চিরবিদায় নিলেন কালাজ্বরে।
রেখে গেলেন কালজয়ী কিছু কবিতা, নাটক আর গল্প। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ওনার রচিত কবিতা শুনেই বড় হয়েছে।
কিন্তু সুকুমার রায় কি শুধুই এডওয়ার্ড লিয়ার আর লুই ক্যারলকে অনুসরণ করে ‘ননসেন্স রাইম’ রচনা করে গেছেন? এর উত্তরটা বহুকাল আগেই কবি সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু এবং আবু সৈয়দ আয়ুব দিয়েছেন তাঁদের সম্পাদিত ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’-য় সুকুমার রায় রচিত কয়েকটি উৎকৃষ্ট ‘ননসেন্স রাইম’-কে সংকলিত করে।
তারপরেই প্রশ্ন জাগে তিনি কি কেবল কবি? অনেক সমালোচক মনে করেন কবি হিসেবেই আমরা সুকুমার রায়কে চিরস্মরণীয় করে রাখবো। শুধুমাত্রই ‘শিশুসাহিত্যিক’-এর গণ্ডির মধ্যে ওনাকে আমরা আবদ্ধ রাখতে রাজি নই। এই কথার যথার্থতা রয়েছে। কারণ, অতি সরল ভাষায় তিনি যে কবিতাগুলি লিখেছেন, তা শুধু শিশুদের মন-ভোলানোর জন্যেই যে লেখা, তা বলা যায় না।
তবে একথা ঠিক, তাঁর বাবার প্রতিষ্ঠিত ‘সন্দেশ’ নামের শিশু পত্রিকাটির জন্যেই তিনি তাঁর কলমে অফুরন্ত ধারা এনে স্নিগ্ধ হাস্য রসে ভরিয়ে দিয়েছেন শিশু ও তাদের অভিভাবকদের প্রাণ।
লেখালেখি শুরু তার আগেই। ১৮৯৬ সালে মাত্র ৯ বছর বয়সে, শিশুপত্রিকা ‘মুকুল’-এ প্রকাশিত হয় বালক সুকুমারের প্রথম কবিতা ‘নদী’। এর পরে নিয়মিত ওই পত্রিকায় ওনার কবিতা মুদ্রিত হয়।
১৯০৪ সালে ‘বয়েজ ওন পেপার’ পত্রিকার নভেম্বর সংখ্যায় ঘোষিত আলোকচিত্র প্রতিযোগিতায় অল এইজেস ডিভিশনের ‘পেটস’ বিভাগে তৃতীয় পুরস্কার অর্জন করেন কিশোর সুকুমার।
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পরের বছর রচনা করেন ‘রামধন বধ’। তবে সেই লেখা পাণ্ডুলিপি হারিয়ে যাওয়ায় ঐতিহাসিক ঘটনাটি সেই কিশোরের মনে কী ছাপ রেখে ছিল, তার হদিশ আমরা পাই না।
১৯০৬ সালে ফিজিকস আর কেমিস্ট্রিতে অনার্সসহ বিএসএসি পাস করেন তিনি। এই সময়েই তার তোলা রবীন্দ্রনাথের একটি ছবি পরের সময়ে ঐতিহাসিক গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে। তরুণ সুকুমারকে স্নেহদানে বঞ্চিত করেননি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
১৩১৮ সালে, ২৪-২৬ বৈশাখ রবীন্দ্রনাথের ৫০-তম জন্মদিন উদ্যাপনের জন্য সুকুমার শান্তিনিকেতনে যান ৷ সেখানে তাঁর রচিত ‘অদ্ভুত রামায়ণ’ গান হয়। সেখানে ছিল—‘ওরে ভাই তোরে তাই কানে কানে কই রে, ঐ আসে, ঐ আসে, ঐ ঐ ঐ রে’। লাইনটি শুনে আশ্রমিকরা তাঁর নাম দেয়, ‘ঐ আসে?’
তরুণ সুকুমার সেই বছরে অক্টোবর মাসে বোম্বে থেকে ‘এস এস অ্যারাবিয়া’ জাহাজে পাড়ি দেন ৷ প্যারিস, ক্যালে, ডোভার হয়ে লন্ডনে পৌঁছালেন ২৩ অক্টোবর।
একদিন বিশ্রাম নিয়ে ২৫ তারিখ ‘লন্ডন কাউন্টি কাউন্সিল স্কুল অব ফটোগ্রেভিং অ্যান্ড লিথোগ্রাফি’-তে ভর্তি হলেন। পড়ার পাশাপাশি সাংগঠনিক কাজ থেমে থাকছিল না। বন্ধ ছিল না অগ্রজ বন্ধু রবীন্দ্রনাথের প্রতি স্ব-আরোপিত দায়িত্ব।
১৯১২ সালে রবীন্দ্রনাথ লন্ডন এলেন ১৬ জুন। ১৯ জুন উইলিয়াম উইনস্ট্যানলি পিয়ার্সনের বাড়িতে বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে নিবন্ধ পড়েন ৷ এবং তারপরেই ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি থেকে উপাদান সংগ্রহ করে সুকুমার বাংলা সাহিত্যের পরম্পরা বিষয়ে লন্ডনে বাঙালি সম্প্রদায়কে নিয়ে একটি সভা আহ্বান করেন।
সেই সভায় শ্রোতা হিসেবে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, এবং উইলিয়াম রথেনস্টাইন সপরিবারে উপস্থিত ছিলেন। নিজের কবিতার ইংরেজি অনুবাদ পাঠ করেন রবীন্দ্রনাথ এই সভায়। উপস্থিত প্রকাশক, সম্পাদকেরা খুশি হন এই অনুবাদে। রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির বছর 'তত্ত্বকৌমুদী' পত্রিকায় ২৮ ফেব্রুয়ারি।
লন্ডনে ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠার কথা জানা যায়। প্রতি রবিবার উপাসনা হতো এই সমাজে। অর্থাৎ সুকুমার রায় প্রবাসে থাকাকালেও নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য বিষয়ে বিচ্যুত হন নাই। তাঁর নাটক ‘চলচ্চিত্ত চঞ্চরী’ নাটকে এই ব্রাহ্মসমাজের তৎকালীন ছবিটি ফুটে উঠেছে। সত্যি কথা বলতে, পরবর্তীকালে ব্রাহ্মসমাজে দলাদলি নিয়ে তীব্র অসন্তোষও প্রকাশ করেছেন কিছু তথ্য-সমৃদ্ধ প্রবন্ধে।
১৯১৩ সালের ১৫ জুন রবীন্দ্রনাথের বাড়ি দুপুরের খাবারে আমন্ত্রিত হলেন তিনি। সেখানে সন্দেশ পত্রিকার প্রথম সংখ্যাটি পড়ে অত্যন্ত খুশি হন রবীন্দ্রনাথ।
সেই বছরেরই ডিসেম্বরের ১৩ তারিখ সুপ্রভা দেবীকে বিয়ে করেন তরুণ সুকুমার। পান্তীর মাঠের কাছে ‘রাজমন্দির’-এ বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। শিলাইদহ থেকে রবীন্দ্রনাথ আসেন। ১৯১৮ সালের রবীন্দ্র জন্মদিনে গান গেয়ে শোনান নববধূ সুপ্রভা।
‘ননসেন্স’ কবিতা লিখলেও সেন্স নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করেনি আজ অবধি। কারণ, সুকুমার রায় তাঁর বিজ্ঞানমনস্ক মনোভাব এবং যুক্তিমনস্কতাকে কখনোই ঘুম পাড়িয়ে রাখেননি।
দেখা যাবে, ‘সন্দেশ’ পত্রিকার ছোট ছোট প্রবন্ধের মাধ্যমে সুকুমার রায় শিশুদের মনোজ্ঞ ভঙ্গিতে শিক্ষা প্রদান করছেন। লেখাগুলিতে খেয়ালখুশি হালকা চালটি বজায় রাখলেও তিনি কোনো কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দেননি কোনোদিন। পরবর্তীকালে, এই ধারাটি বজায় রাখবার কারণে, ‘সন্দেশ’ বাংলা পত্রিকা জগতে এক উজ্জ্বল স্থান দখল করে।
সন্দেশ সম্পাদক হিসেবে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার লক্ষ্যে যত্নবান ছিলেন সুকুমার রায়। তাঁর রচিত শিক্ষাপ্রচারমূলক নিবন্ধগুলি থেকে অনুসন্ধিৎসু শিক্ষক এবং বৈজ্ঞানিক সুকুমার রায়কে তাই চিনে নিতে অসুবিধা হয় না। তখঙ্কার বিজ্ঞান দুনিয়া, যন্ত্রসভ্যতার নিত্যনতুন আবিষ্কারের ইতিহাসকে কিশোর-কিশোরীদের কাছে তিনি পৌঁছে দিয়েছেন সরল এবং সাবলীল ভাষায়।
তাঁর এই উপস্থাপনাগুলির গুণ শুধু পণ্ডিত, বৈজ্ঞানিক, গবেষক, ইতিহাসবিদদের কাছেই উচ্চ-প্রশংসিত হয় না। নতুন লেখকদেরও এই ধারায় লিখতে উৎসাহিত করে।
বাংলা মুদ্রণ ইতিহাসে এক কিংবদন্তি, তাঁর বাবা উপেন্দ্রকিশোর রায়ের অবদান অনস্বীকার্য। ছেলে সুকুমারও সেই পরম্পরা বজায় রেখেছেন নিরলসভাবে।
মাত্র ৩৬ বছর বয়সে প্রয়াত না হলে, তাঁর সৃষ্টিশীলতা এবং উদ্যোগ যে আমাদের কেমন ভাবে অনুপ্রাণিত করতে পারতো, তা ভাবলে দুঃখ আর আক্ষেপটুকুই হয়ে ওঠে আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ।
Комментарии