রমেশ সিপ্পির ‘শোলে’ ছবিটি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে চিত্রপরিচালক শেখর কাপুর বলেছিলেন, ভারতীয় চলচ্চিত্রকে দুটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারেঃ ‘শোলে’র আগের যুগ এবং ‘শোলের পরের যুগ। কথাটা উল্লেখের কারণ, বিশ্ব তথা ভারত গত এক বছর ধরে এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে শেখর কাপুরের কথাটাকেই ধার করে বলা যায়, কোভিড অতিমারির আগের যুগ এবং কোভিড অতিমারির পরের যুগ।
ভারতের অর্থনীতি এবং সামাজিক প্রবণতাগুলি দেখলে কথাটিকে শুধরে এমনটাই বলা যায় যে লকডাউনের আগের যুগ এবং লকডাউনের পরের যুগ। ২০২২ সালটিকে ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরো আখ্যা দিয়েছে ‘আত্মহত্যার বছর’। কারণ, তাদের সংগৃহীত তথ্যে দেখা যাচ্ছে ভারতে ২০২২ সালে ১ লক্ষ ৬৪ হাজার ৩৩ জন মানুষ আত্মহত্যা করেছেন। গত ৫৬ বছরের নিরিখে যে সংখ্যাটি সর্বোচ্চ।
কোভিড অতিমারিতে তড়িঘড়ি করে দেশের প্রধানমন্ত্রী লকডাউন ঘোষণা করে দিলেন। সেই মুহূর্তে তিনি কোন বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন, তার সঠিক হদিশ সাধারণ মানুষ জানেন না।
২০১৯ সালে হংকঙ অধিবাসীরা চীন সরকার আরোপিত ‘বিদেশী অপরাধী নির্ধারণ (Fugitive Offenders’ Ordinance’-এর বিল প্রস্তাবের বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার করে। ঠিক একইভাবে ভারতে CAA এবং NRC-র প্রস্তাব তথা ‘ক্রনোলজি’ বোঝানোর বিরুদ্ধে সারা দেশের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।
শাহিনবাগ, পার্ক সার্কাস সহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সেই বিক্ষোভ সামাল দিতে না পেরে প্রায় বিনা প্রস্তুতিতে লকডাউন ঘোষণা করে আন্দোলনটিকে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়। অবশ্য সরকারীভাবে প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দেন যে কোভিড সংক্রমণ থেকে মানুষকে বাঁচাতেই তাঁকে ‘বাধ্য হয়ে এই পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে’।
সাধারণ মানুষ এও জানেন না লকডাউনের ফলে কোভিড সংক্রমণ কতটা রোখা গেছিল। তবে তাঁরা দেখেছেন কুম্ভমেলা থেকে শুরু করে রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন – সব কিছু এই লকডাউনের মধ্যেই সরকার আয়োজন করে। লকডাউনের সীমা যতটা বাড়ানো হয়েছে, ততই বেড়েছে মানুষের দুর্ভোগ।
একদিকে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ সংস্কৃতিকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে, এবং অন্যদিকে চাকরি থেকে ছাটাই হয়েছে অসংখ্য মানুষ। ক্ষুদ্র ও মধ্য মাপের উদ্যোগগুলির যে কটা ২০১৬ সালের নোটবন্দির পরেও নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পেরেছিল, তাদেরকেও লাটে ওঠানোর পূর্ণতা দেয় এই দীর্ঘ সময়ের লকডাউন।
ঘরে বন্দি মানুষদের জীবনে সুরক্ষার অভাব ক্রমাগত বাড়িয়ে গেছে ইলেকট্রনিক মিডিয়া। ক্রিকেটের স্কোরকার্ডের মতো সারা দিন ধরে বাড়তেই দেখেছে। এর ফলে বাড়ির শিশু সদস্যদের থেকে শুরু মধ্যবয়সী এবং প্রৌঢ় মানুষদের মানসিক এবং শারীরিক – দুই প্রকার স্বাস্থ্যেরই অবনতি ঘটেছে। বস্তুত, কোভিড অতিমারি কতজন মানুষের মৃত্যুর প্রত্যক্ষ কারণ হয়েছে, আর কতজন মানুষ কোমরবিডিটির কারণে প্রাণ হারিয়েছেন, তা নিয়ে বৈজ্ঞানিক ও গবেষকদের মধ্যেই নানা প্রশ্নের জন্ম হয়েছে।
এই পরিপ্রেক্ষিত থেকেই দেখসা প্রয়োজন ২০২২ সাল ‘আত্মহত্যার বছর’ হিসেবে গণ্য হচ্ছে কেন। কৃষকদের কথাই যদি ধরা যায় সর্বপ্রথমে, তাহলে দেখা যাবে সরকারের ন্যুনতম বিক্রয় মূল্য নিয়ে নানান টালবাহানায় অধিকাংশ কৃষকর মহাজনের ঋণ শোধ করতে পারেননি। এবং ‘ঋণখেলাপি’ কৃষকদের এক বড় অংশ যে সাধারণত আত্মহত্যার পথ বেছে নেন, তা তো গত ৯ বা তার বেশি বছর ধরে ভারতের কঠিন বাস্তব।
দ্বিতীয়, সুরক্ষা সেনানী ও পুলিশকর্মীরা, বিশেষ করে যারা অধস্তন পদে আছেন। এনাদের প্রতি উর্ধতন কতৃপক্ষ যে চাপ সৃষ্টি করে থাকেন, তা বহু ক্ষেত্রেই অমানবিক পর্যায়ে পৌঁছে যায়। ব্যক্তি এবং ইউনিট – দুই ক্ষেত্রেই দেওয়া সব ধরণের আদেশকেই দেশরক্ষার দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত করবার পরিণাম যে শুভ হতে পারে না, তা স্বীকার করতেই হবে তরতাজা জওয়ানদের প্রাণহীন দেহগুলির দিকে তাকিয়ে। চাপ, অপমান, দৈহিক ও মানসিক পীড়ন নিতে নিতে এক সময়ে ‘হার’ মেনেছে তাঁরা। আর কোনভাবেই বা তাঁরা বলতে পারতেন, ‘I quit’?
তৃতীয় শ্রেণীতে আসবে কিশোর-কিশোরী বিদ্যার্থীরা। ‘অনলাইন ক্লাস’ নামক এক নতুন ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত হতে হয়েছে তাদের। এমন একটি ব্যবস্থা, যার এক প্রান্তে থাকা শিক্ষক- শিক্ষিকা এবং অন্য প্রান্তের ছাত্রসমাজ – কেউই জানেনা কী পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। অধিকাংশ শিক্ষক-শিক্ষিকা ক্যামেরার সামনে কীভাবে পড়াতে হয় শেখেনওনি, শেখবার ইচ্ছা যে ছিল তা বলা যায় না। চাকরিটুকু বাঁচানোর দায় যতটুকু করতে হয়, ততটুকুই করতে তাঁরা বিরক্ত, বিভ্রান্ত।/ আর ছাত্রসমাজ – বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র ছাত্রসমাজের একটি বড় অংশ পড়াশোনা ছেড়ে টাকা রোজগারের ফিকিরে ব্যস্ত হয়েছে। সেখানেও লাঞ্চনা আর শোষণ ছাড়া আর কিছুই নেই।
অপেক্ষাকৃত ধনী ছাত্রদের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা তুঙ্গে ওঠার কারণে ধ্বংসাত্মক এবং নেতিবাচক প্রবৃত্তিগুলি মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। অনেক ক্ষেত্রে, স্কুলের পরিসরটুকু না পাবার কারণে, ঘরবন্দি বাবা-মা এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে ঐক্যতার বদলে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব বেড়েছে, এবং সেই অবমাননার পরিস্থিতিতে মধ্যস্ততা বা বিরোধ প্রশমিত করবার জন্যে কেউ উপস্থিত নেই – না বন্ধু, না পরিজন, না শিক্ষক। এমন অবস্থায় বেঁচে থাকবার চেয়ে আত্মহত্যাকে যদি তারা সহজ পথ বলে ধরে নেয়, সমাজ কি তাদের দোষ দিতে পারে?
চতুর্থত দেখা যাচ্ছে, আত্মহননকারীদের বৃহত্তর অংশটাই আপাতদৃষ্টিতে ‘সুখী’ পরিবারের যুবক ও যুবতী। ইংরেজিতে এরা upwardly mobile শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। যারা hot and happening হয়ে ওঠার তাড়নায় ধার নেওয়া টাকায় তরল ভাষায় যাকে বলে ‘ফুটানি মারতে’ বিন্দুমাত্র ইতস্তত করে না। ধার নিলে যে ধার সহ্য করতে হবে – এই গুরুত্বপূর্ণ কথাটাই তারা বেমালুম ভুলে যায়। ঋণ-প্রদানকারী সংস্থারা যেহেতু খয়রাত করতে বাজারে আসেনি, তাই যখন এই শ্রেণীর মানুষকে ঋণখেলাপি আখ্যা দিয়ে চিহ্নিত করে, তখন দুর্দশাগ্রস্ত সুবিধাভোগীরা স্বভাবতই আত্মহত্যাকেই শ্রেয় পথ বলে বেছে নিয়েছে।
পঞ্চমত এবং শেষ শ্রেণীতে রয়েছেন সেই বয়স্করা, যারা শরীরে ব্যাধি ঘর বাঁধলে ব্যাধি তাড়ানোর উপায় খোঁজার চেয়েও বেশি খোঁজেন আপন পরিবারের সদস্যদের থেকে অপমানিত না হওয়ার উপায়। সত্যি কথা বলতে কি, আত্মহননকারী এই শ্রেনীটি নীরবে এই সমাজকেই নীরবে ভর্ৎসনা করে যায়। শারীরিক দিক থেকে দুর্বল এবং মানসিক দিক থেকে অসহায় এই প্রৌঢ়সমাজকেই সবচেয়ে বেশি আক্রমণ করেছে সুবিধাবাদী প্রশাসন এবং সরকার। এনাদের সাহায্য করবার অজুহাতে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা নিজেরাই প্রচারের আলোয় আস্তে উৎসুক হয়েছেন।
কোভিড অতিমারি তথা লকডাউনের পর থেকে সাধারণ মানুষ চুড়ান্ত ভয় পেয়েছেন। আরও বেশি ভয় পেয়েছেন এই সত্যিটা জেনে যে দেশের সরকার বা পরিবারের সদস্যরা নিজেরটুকু নিয়ে এতটাই ব্যস্ত, যে তাঁদের দিকে হাত বাড়িয়ে দেওয়ার ইচ্ছা, সময় বা টাকা – কোনোটাই নেই।
ইন্ডিয়ার হোক, বা ভারত – সাধারণ মানুষ কিন্তু বিপর্যস্ত। প্রচারের আলোয় দাঁড়ালে সামনেটা অন্ধকারই দেখায়। সেখানে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষদের ভিড় জমেছে। প্রচারের আলো থেকে নেতা-নেত্রীরা বার হয়ে এসে এই ভিড়ের মাঝখানে দাঁড়ালে বুঝবেন অসহায়তার গন্ধ এতটাই তীব্র যে অনেক মানুষ সেই গন্ধ থেকে চিরতরে মুক্তি পেতে আত্মহননকে বেছে নিতেও আর দ্বিধা করছেন না।
সব কুছ ঠিক নহি হ্যাঁয়।
Comments