রাশিয়ায় ১৫ই মার্চ থেকে ১৭ই মার্চ পর্যন্ত তিন দিনব্যাপি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। অনেকেরই বিশ্বাস এটা আগে থেকেই চূড়ান্ত যে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনই জিতবেন এবং পঞ্চমবারের মতো দায়িত্ব নেবেন। তাহলে কেন ক্রেমলিন এত আয়োজন করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করছে? আর এই নির্বাচন থেকে প্রেসিডেন্ট পুতিনের সত্যিকারের জনপ্রিয়তার ধারণা পাওয়া যাবে কি?
ভ্লাদিমির পুতিন সেই ২০০০ সাল থেকেই রাশিয়ার ক্ষমতায়। প্রথমে তার পূর্বসূরি বরিস ইয়েলতসিনের দ্বারা ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন, আর ২০০০ সালের মার্চে তিনি প্রথমবার নির্বাচনে জয়লাভ করেন।
২০০৮ থেকে ২০১২, এই সময়টায় তিনি তার ভূমিকা বদলে নেন, সেসময় তিনি প্রধানমন্ত্রীর চেয়ার বসলেও ক্ষমতা পুরোপুরি নিজের কাছে রাখেন।
সে সময়টায় রাশিয়ার সংবিধান অনুযায়ী একজন প্রেসিডেন্ট টানা দুবার ক্ষমতায় থাকতে পারতেন। এ কারণেই তিনি ভূমিকা বদলে আবারও নতুন করে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচনে আসনেও যাত্রা শুরু করেন। ২০২০ সালে সংবিধানের সেই নিয়মেও পরিবর্তন আসে। এখন বহুল প্রচলিত বিশ্বাস হল প্রেসিডেন্ট পুতিন ২০৩৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবেন।
আর সে পর্যন্ত থাকলে তিনি হবেন রাশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা শাসক। তিনি পেছনে ফেলবেন কম্যুনিস্ট নেতা জোসেফ স্ট্যালিন ও অষ্টাদশ শতকের সম্রাজ্ঞী ক্যাথরিন দ্য গ্রেটকে, যারা দুজনেই ৩০ বছরের বেশি ক্ষমতায় ছিলেন।
সমর্থন দেখানো
রাশিয়ার নির্বাচনে কখনোই তেমন কোন প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকেনা। কিন্তু এর ফলাফল জরুরি যারা ক্ষমতায় যায় তাদের বৈধতা দেয়ার জন্য এবং দেখানোর জন্য যে জনগণের ইচ্ছার গুরুত্ব আছে।
এবার যেমন ভ্লাদিমির পুতিনের জন্য শুধু জয়টাই গুরুত্বপূর্ণ নয়, একইসাথে ভোটার উপস্থিতি এবং তার প্রতি সমর্থন বাড়াটাও জরুরি।
যেহেতু দেশটি এখন একটা পুরোপুরি যুদ্ধের মধ্যে আছে যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়তে যাচ্ছে রাশিয়া এবং বাকি বিশ্বের ওপরও।
রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের জন্য, এই নির্বাচন তাদের সামর্থ্যের একটা পরীক্ষা যাতে তারা সমস্ত প্রশাসনিক উপায় ব্যবহার করে তাদের প্রেসিডেন্টকে একটা নিরুঙ্কুশ বিজয় এনে দিতে পারে।
রাশিয়ার স্বাধীন গণমাধ্যম মেদুজার রিপোর্ট, ক্রেমলিন অন্তত ৭০ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি আশা করছে, যার মধ্যে ৮০ শতাংশ ভোট পাবেন ভ্লাদিমির পুতিন। যা তার ২০১৮ সালে পাওয়া ৭৬.৭ শতাংশ টপকে যায়।
বিবিসির নিজস্ব গবেষণায় দেখা যায় এই ফল পেতে হলে, প্রশাসনকে রাষ্ট্রের সমস্ত কর্মীকে সচল করে তুলতে হবে – যারা স্থানীয় এবং কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের সাথে কাজ করছে এবং রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত কর্পোরেশনেও যুক্ত – তাদেরকে উৎসাহ সহকারে নির্বাচনে অংশ নিতে হবে এবং বর্তমান প্রেসিডেন্টকে সমর্থন দিতে হবে।
নির্বাচনে এক কোটির বেশি ভোটার রয়েছে। এর মধ্যে আছে ইউক্রেনের দখলকৃত এলাকা – ক্রিমিয়া ও দনবাস অঞ্চলের কিছু এলাকা, যা রাশিয়া ২০১৪ সাল থেকে অবৈধভাব দখল করে আছে, সেই সঙ্গে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে দখলে রাখা ইউক্রেনের পূর্ব ও দক্ষিণের কিছু অঞ্চলের অধিবাসীও।
দেশের বাইরে থাকা আরও প্রায় ২০ লাখ রাশিয়ান এতে ভোট দিতে পারবেন, যার মধ্যে প্রতিবেশি কাজাকস্তানে আছে ১২ হাজার রাশিয়ান, যেখানে বাইকুনোর ভাড়া করে মহাকাশ উৎক্ষেপণ কেন্দ্র স্থাপন করেছে রাশিয়া।
যুদ্ধ এবং নির্বাচন
নির্বাচনি প্রচারণার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে দেখা গেছে ভ্লাদিমির পুতিনকে। শুরুর দিকে তিনি বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে শিক্ষার্থী এবং শ্রমিকদের সঙ্গে দেখা করেন।
ইউক্রেনে অভিযানকে মস্কো বলছে “বিশেষ সামরিক অপারেশন”। সে বিষয়ে কোনরকম কথা বলা এড়িয়ে গেছেন ভ্লাদিমির পুতিন।
কিন্তু এই যুদ্ধ এখন রাশিয়ার প্রতিদিনের জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা, সীমিত বিদেশ ভ্রমণ, বিদেশি আমদানি পণ্য কমে আসা এবং ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা থেকে একরকম বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া।
এই যুদ্ধ হাজারো রাশিয়ান সৈন্যর প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। আরও লাখো রাশিয়ান, যাদের বেশিরভাগ তরুণ, শিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের তারা গত ২৪ মাসে দেশ ছেড়েছে, কারণ তারা হয় এই যুদ্ধের পক্ষে নয় অথবা যুদ্ধে যেতে রাজি হয়নি।
তাই নির্বাচনি প্রচারণায় যুদ্ধ ব্যাপারটা অনুপস্থিত থাকলেও মিডিয়ার কাছে এটি একটি প্রধান অনুসঙ্গ এবং সাধারণ রাশিয়াদের এটি এড়ানোর কোন সুযোগ নেই।
উচ্চ ভোটার উপস্থিতির হার ও প্রেসিডেন্টের প্রতি নিরুঙ্কুশ সমর্থন যুদ্ধসহ তার আসন্ন সবগুলো সিদ্ধান্তকেই আসলে বৈধতা দেবে।
পুতিন ছাড়াও কি প্রেসিডেন্ট প্রার্থী আছে?
ভ্লাদিমির পুতিন ছাড়াও আরো তিনজন নিবন্ধিত প্রার্থী আছেন। তারা হলেন লিওনিদ স্লাটস্কি, তিনি একজন জাতীয়তাবাদী কনজারভেটিভ, কম্যুনিস্ট পার্টির পার্থী নিকোলাই খারিতোনভ এবং ব্যবসায়ী ভ্লাদিস্লাভ দাভানকোভ, যিনি সদ্য প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল “নিউ পিপল” থেকে নির্বাচনে এসেছেন। দুমা রাজ্য থেকে রাশিয়ার সংসদের নিম্নকক্ষে দলটির অল্প কিছু প্রতিনিধি আছে।
এ তিনজনই ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে এবং প্রেসিডেন্ট পুতিনকে সমর্থন দিয়ে আসছেন এবং তাদের কেউই আসলে পুতিনের জন্য সত্যিকারের হুমকি নয়।
যারা তার সত্যিকারের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল তারা হয় কারাগারে, নয়তো তাদের সরিয়ে ফেলা হয়েছে কিংবা তারা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে।
পুতিনের সবচেয়ে শক্ত প্রতিদ্বন্দি অ্যালেক্সেই নাভালনি এই ফেব্রুয়ারিতে কারাগারের কড়া নিরাপত্তার মধ্যে মারা যান।
বিবিসির স্টিভ রোজেনবার্গ নিকোলাই খারিতোনভকে জিজ্ঞেস করেন - তিনি কি মনে করেন সুযোগ পেলে তিনি ভ্লাদিমির পুতিনের চেয়ে আরও ভালো প্রেসিডেন্ট হবেন?
তখন এর উত্তরে এই প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বলেন, এটা তিনি বলতে পারেন না, বরং ভোটাররাই এ ব্যাপারে ‘সিদ্ধান্ত নেবে’।
একই সাথে মি. খারিতোনভ “ভবিষ্যতে বামপন্থী রাজনীতির” ডাক দিচ্ছেন। তিনি ২০২২ সাল থেকে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় আছেন।
লিওনিদ স্লাটস্কি, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি অফ রাশিয়ার (এলডিপিআর) একজন এমপি, তার বিরুদ্ধে বেশ কিছু যৌন হয়রানির অভিযোগ আছে। তিনি দলখকৃত ক্রিমিয়ায় রাষ্ট্রীয় সফরে গিয়েছিলেন এবং ২০১৪ সাল থেকে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার আওতায় আছেন।
ভ্লাদিস্লাভ দাভানকোভ, একটি নতুন রাজনৈতিক দলের নতুন মুখ, গণমাধ্যমে তার উপস্থিতি সবচেয়ে কম।
একটি কসমেটিক্স কোম্পানির সহ প্রতিষ্ঠাতা দাভানকোভ ২০২৩ সালে মস্কোর মেয়র নির্বাচনে মাত্র ৫ শতাংশ ভোট পান। ইউক্রেনের সাথে যুদ্ধে তিনি “শান্তি ও আলোচনার” পক্ষে থাকলেও, ইউক্রেনের অঞ্চল দখলের পক্ষে ভোট দেন, ফলে তিনি আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েছেন।
যুদ্ধ বিরোধী অবস্থান নিয়ে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হতে চাওয়া বরিস নাদেজদিনকে নিবন্ধনই করতে দেয়নি কর্তৃপক্ষ, যদিও তার পক্ষে স্বাক্ষর দিয়ে সমর্থন জানাতে হাজার হাজার রাশিয়ান লাইন ধরেছিলেন।
ভোট প্রক্রিয়া
রাশিয়ার ইতিহাসে প্রথম বারের মতো প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচন ১৫ থেকে ১৭ মার্চ, অর্থাৎ তিনদিন ধরে চলবে।
এর প্রথম পরীক্ষামূলক নির্বাচন হয়েছিল ২০২০ সালে। তখন কোভিড মহামারি চলাকালীন 'জনস্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে' সংবিধান সংশোধন করা হয়।
যদিও এখন মহামারির কারণে কোন স্বাস্থ্যঝুঁকি নেই, তবুও একই পদ্ধতি অবলম্বন করেই এবারের নির্বাচনে ভোট গ্রহণ হচ্ছে।
তবে স্বতন্ত্র পর্যবেক্ষকরা তিন দিনব্যাপী নির্বাচনের সমালোচনা করছেন। তাদের মতে, এভাবে ভোট নেয়ার ফলে নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার বিষয়টি আরও জটিল হয়ে উঠবে।
একইসঙ্গে, প্রথমবারের মতো ঘরে বসেই ভোট দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিশেষ করে সেই জায়গাগুলোতে যেখানে নির্বাচন ঘিরে প্রতিবাদ চলমান, আবার ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করার বিষয়টি নিয়েও রয়েছে শঙ্কা।
ইউক্রেনের দখল করা জায়গাগুলোকেও এই নির্বাচনে অন্তর্ভুক্ত করেছে রাশিয়া। আর এনিয়ে আছে সমালোচনা। এমনকি ওইসব স্থানের স্থানীয় বাসিন্দাদের ওপর চাপ প্রয়োগেরও অভিযোগ আসছে।
১৯৯৩ সাল থেকে অর্গানাইজেশন ফর দ্য সিকিউরিটি অ্যান্ড কোঅপারেশন ইন ইউরোপের (ওএসসিই) পার্লামেন্টারি অ্যাসেম্বলি (পিএ) রাশিয়ায় তাদের পর্যবেক্ষক পাঠালেও গত তিন বছর ধরে তা বন্ধ আছে।
আদৌ কিছু বদলাবে?
রাশিয়ায় কোনো স্বতন্ত্র জরিপ নেই আর রাষ্ট্রীয় মিডিয়া থেকেই খবর পান বেশিরভাগ রাশিয়ান। আর এই গণমাধ্যমগুলোর বিরুদ্ধে ভ্লাদিমির পুতিন ও তার নীতির প্রতি ব্যাপকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট হবার অভিযোগ রয়েছে।
তবুও বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস যে সরকারের দেখানো কর্মকাণ্ড নিয়ে রাশিয়ানরা যথেষ্ট সন্দিহান। কিন্তু এনিয়ে তারা কথা বলতে ভয় পায়।
এমনকি বিরোধীদের সামান্য সমর্থনেও কঠোর শাস্তির ঝুঁকি থাকায় তারা প্রকাশ্যে নিজেদের ভিন্নমত প্রকাশ করে না।
আলেক্সি নাভালনির বিধবা স্ত্রী, ইউলিয়া, তার স্বদেশীদের এই ভোট বয়কট করার পাশাপাশি বিদেশি সরকারগুলোকে এই নির্বাচনের ফলাফলকে স্বীকৃতি না দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
দ্বিতীয় আহ্বানে সাড়া মেলার সম্ভাবনা কম থাকলেও, প্রথমটি সম্ভব। স্বাধীন গণমাধ্যম মেদুজা পুতিন-প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ এক সূত্রকে উদ্ধৃত করে বলেছে যে নির্বাচনে কম ভোটার উপস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে।
“বর্তমান প্রেসিডেন্টই আবার নির্বাচিত হবে- এনিয়ে মানুষের মনে যদি কোন সন্দেহই না থাকে তবে কেউ কেন কোথাও যাবে?"
এই নির্বাচনের সম্ভাব্য ফলাফল হলো ভ্লাদিমির পুতিনের জন্য অন্তত কাগজে কলমে একটি বিশ্বাসযোগ্য বিজয়।
তবে কম ভোটার উপস্থিতির অর্থ দাঁড়াবে রাষ্ট্রপতির প্রতি সমর্থন ক্রমশই দুর্বল হয়ে পড়েছে, আর এর ফলাফলস্বরূপ কঠোর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ আরোপ, যাতে রাশিয়া আরও বেশি ভয় ও নিপীড়নের দিকে ধাবিত হতে পারে।
Comments