এক জন তো গ্রেফতার হয়েছেন। কিন্তু তিনি কি একাই ছিলেন? নাকি শুক্রবার ভোরে আরজি করের অকুস্থলে আরও কেউ ছিলেন? চার তলার সেমিনার হলে মহিলা চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় কি আরও কেউ জড়িত? আপাতত সেই উত্তর হাতড়াচ্ছে কলকাতা পুলিশ। কিন্তু হাতে বেশি সময় নেই। মুখ্যমন্ত্রী সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন। রবিবারের মধ্যে তদন্তের ‘কিনারা’ না হলে, তদন্তভার সিবিআইকে দিয়ে দেওয়া হবে। কঠিন পরীক্ষার সামনে কলকাতা পুলিশ। সম্ভবত সাম্প্রতিক অতীতে সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষার মুখে কলকাতা পুলিশ। তারা কি উত্তীর্ণ হতে পারবে?
পুলিশের সামনে বড় পরীক্ষা
হাতে সময় কম। ঘড়ির কাঁটা ঘুরে চলছে। পুলিশকেও তাই আরও বড় করতে হয়েছে তদন্তকারী দলের আয়তন। আরজি কর কাণ্ডে যে বিশেষ তদন্তকারী দল গঠন হয়েছিল, তাতে প্রথমে ছিলেন সাত জন সদস্য। এ বার সেই সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে ১২ করা হয়েছে। এ ছাড়াও সিটের তদন্তকারী অফিসারদের সাহায্য করতে থাকছেন ১৫০ জন পুলিশকর্মী। আন্দোলনকারীরা সন্দেহ করছেন, একাধিক ব্যক্তি জড়িত থাকতে পারেন এই ঘটনায়। সোমবার পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাতের পর সে তত্ত্ব উড়িয়ে দেননি মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলও।
সে ক্ষেত্রে যদি সত্যিই এ ঘটনায় আরও কেউ জড়িত থাকেন, তাঁদের রবিবারের মধ্যে খুঁজে বের করতে গেলে এই তদন্তে একটি বড় দলের প্রয়োজন। সেই কারণেই সিটের সদস্য সংখ্যা আরও বাড়ানো হল বলে অনুমান বিভিন্ন মহলের। সঙ্গে সেই বিশেষ তদন্তকারী দলকে সহযোগিতার জন্য রাখা হয়েছে আরও ১৫০ জন পুলিশকর্মীকে। সূত্রের খবর, তদন্তে গতি আনতে আগামী কয়েক দিন ২৪ ঘণ্টা কাজ করবে এই দল। তিনটি শিফটে কাজ চলবে। ১৫০ জনের দলকে ৫০ জন করে তিনটি ভাগে ভাগ করা হবে। প্রতিটি শিফটে ৫০ জন করে পুলিশকর্মী কর্মরত থাকবেন আরজি করের তদন্তের কাজে।
আরও কেউ জড়িত রয়েছেন কি না, তা খুঁজে বের করতে গেলে প্রচুর সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। ধৃত অভিযুক্ত হাসপাতালে কোন কোন জায়গায় ঘুরঘুর করতেন, কাদের সঙ্গে কথা বলতেন, ঘটনার দিন বা তার আগের দিন হাসপাতালে কাদের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ করেছিলেন বা দেখা করেছিলেন, সেই সব বিষয় খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। যদিও পুলিশ সূত্রে খবর, ধৃত ব্যক্তি জেরায় দাবি করেছেন তিনি একাই ছিলেন। অপারেশন থিয়েটার খুঁজতে খুঁজতে চার তলায় সেমিনার কক্ষে পৌঁছে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে পাঁচ তলায় এবং আরও বেশ কয়েক জায়গায় ঘোরাঘুরি করতে দেখা গিয়েছিল। ফলে সম্ভব্য সব দিক খতিয়ে দেখতে চাইছেন সিটের তদন্তকারী দলের অফিসারেরা।
বিতর্ক একটা নয়
শুধু তাই নয়, মহিলা চিকিৎসকের মৃত্যুর পর প্রথমেই সেটিকে ‘আত্মহত্যা’ বলে দেখানোর চেষ্টা হয়েছিল বলে অভিযোগও উঠে আসছে। শুক্রবার সকালে যখন পরিবারের কাছে প্রথম মৃত্যুসংবাদ গিয়েছিল, তখন বলা হয়েছিল তিনি আত্মহত্যা করেছেন। সূত্রের দাবি, ফোনটি করেছিলেন হাসপাতালের বক্ষ রোগ বিভাগের সহকারী সুপার। তাঁকে এ বার জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার বেলা ১১টায় তাঁকে ডেকে পাঠানো হয়েছে। তলব করা হয়েছে বক্ষরোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধানকেও।
মুখ্যমন্ত্রীর পদক্ষেপ
সোমবার দুপুরেই মৃত চিকিৎসকের বাড়িতে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সঙ্গে ছিলেন পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলও। পরিবারের সঙ্গে দেখা করে বেরিয়েও মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দেন, পুলিশি তদন্তের সময়সীমার কথা। জানিয়ে দেন, রবিবারের মধ্যে তদন্তের কিনারা না হলে, এই ঘটনার তদন্তভার সিবিআইকে দিয়ে দেওয়া হবে। যদিও কলকাতা পুলিশের অতীতের ট্র্যাক রেকর্ডেরও প্রশংসা করেন তিনি। পুলিশ কমিশনারও আশ্বস্ত করেছেন, যদি আরও কেউ জড়িত থাকেন, তাঁদের ৪-৫ দিনের মধ্যে গ্রেফতার করা হবে। সে জায়গায় নিজেদের আরও এক বার প্রমাণ করতে পুলিশের কাছে এটি বাড়তি চ্যালেঞ্জ বলেই মনে করছে পুলিশ মহলেরই একাংশ।
অভিযুক্তের গতিবিধি নিয়ে সংশয়
যে ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে, সূত্রের দাবি তিনি পেশায় সিভিক ভলান্টিয়ার। যদিও পুলিশের তরফে এ নিয়ে কোনও স্পষ্ট মন্তব্য মেলেনি। যদিও আরজি কর-কাণ্ডে ধৃতের ‘প্রভাবশালী’ যোগের ইঙ্গিতও উঠে আসতে শুরু করেছে। সূত্রের দাবি, ওই সিভিক ভলান্টিয়ার পুলিশের ওয়েলফেয়ার কমিটির সঙ্গেও যুক্ত। কিন্তু পুলিশ ওয়েলফেয়ার কমিটিতে সাধারণত পুলিশকর্মীরাই থাকেন। সিভিক ভলান্টিয়াররা পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে কাজ করলেও, বাহিনীর সরাসরি অঙ্গ নয়। তা হলে তিনি কী ভাবে ওই কমিটির সঙ্গে যুক্ত হলেন, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। শুধু তাই নয়, ওই ব্যক্তি সল্টলেকে পুলিশের ৪ নম্বর ব্যাটেলিয়নে থাকতেন বলে অভিযোগ। সেখানেই বা তাঁর থাকার ‘অধিকার’ কী ভাবে মিলল? তা হলে কি নেপথ্যে কোনও ‘প্রভাবশালী’ যোগ? জোরালো হচ্ছে সেই তত্ত্ব।
এ তো গেল, তাঁর পেশাগত দিক। সূত্রের দাবি, তিনি মাঝে মধ্যেই হাসপাতালে রোগী নিয়ে যেতেন। এত রোগী কোথা থেকে পেতেন তিনি? পুলিশ সূত্রে খবর, জেরায় ওই ব্যক্তি জানিয়েছে অনেক রোগীর চিকিৎসা করানোর সুপারিশ থাকত তাঁর কাছে। সেই সূত্রেই আসতেন হাসপাতালে এবং বেশ কয়েকজনের সঙ্গে চেনা-পরিচিতিও হয়ে গিয়েছিল। ধৃতকে জেরা করে পাওয়া এই তথ্যগুলিকে একত্রিত করেই, তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন পুলিশকর্মীরা।
বিক্ষোভে আন্দোলনে উত্তাল রাজ্য
এক দিকে যখন তদন্ত চলছে, তখন অন্য দিকে চলছে বিক্ষোভ, প্রতিবাদ। আরজি কর হাসপাতালের ঘটনাপ্রবাহ যে ভাবে এগিয়েছে, তাতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে বিক্ষোভের আঁচ। এর মধ্যেই সোমবার সকালে আরজি করের অধ্যক্ষ পদে ইস্তফা দিয়ে চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেন সন্দীপ ঘোষ। পরে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, সন্দীপকে যে ভাবে গালিগালাজ করা হয়েছে, সেটি তাঁর খারাপ লেগেছে। সন্দীপকে রাজ্য সরকার অন্য কোথাও সরিয়ে দেবে, সে কথাও বলেছিলেন মমতা। এর পর দুপুর গড়িয়ে সন্ধে হতেই ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষের চেয়ারে বসানো হয়েছে সন্দীপকে। এই পরিস্থিতির মধ্যেও সন্দীপকে আবার অন্য একটি মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষের পদে বসানো ঘিরেও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। সেখানকার পড়ুয়ারাও তাঁকে মেনে নিচ্ছেন না। ন্যাশনালে অধ্যক্ষের ঘরে পড়ুয়ারা সোমবার তালা ঝুলিয়ে দেন। এখন ঘটনার জল কোনদিকে গড়ায় তা দেখার জন্য রাজ্যবাসীও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন।
Comments