সংসদের বিশেষ অধিবেশনের উদ্দেশ্য নিয়ে সারা দেসেই ধোঁয়াশা ছিল ১৭ সেপ্টেম্বর অবধি। তবে পরের দিনই অনেকটা স্পষ্ট হয়ে যায় যখন এই বিশেষ অধিবেশনের উদ্বোধনী ভাষণে সংসদ ভবন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাবপ্রবণ বক্তব্যটি রাখেন। সাংসদেরা তখনই বুঝতে পারেন ব্রিটিশদের বানানো সংসদ ভবন থেকে বিদায় নিয়ে এবার আরএসএস-এর হিংস্র সিংহমূর্তির অশোকস্তম্ভের নিচে নতুন সংসদ ভবনে অধিবেশনে উপস্থিত হয়ে অধিবেশন চালিয়ে যেতে হবে।
এই স্থানান্তরটি কি শুধুই এক ভৌগলিক অবস্থান থেকে আরেক ভৌগলিক অবস্থানে যাওয়া? সম্ভবত নয়। যে উগ্র সংখ্যাধিক্যবাদ নিয়ে ক্ষমতাসীন বিজেপি-র নেতৃত্বে নরেন্দ্র মোদী শাসনদণ্ড ঘুরিয়ে চলেছেন তাঁর বাকসিদ্ধ বাণগুলির জোরে, তা প্রবলভাবে অন্য এক চিন্তার উদ্রেক করে। তা হলো ভারতের ইতিহাস নতুন করে রচনা করবার এক উদগ্র প্রয়াস।
এর প্রথম ইঙ্গিত ছিল বিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচী বদলে সংখ্যাধিক্যের জয়গান গাওয়া পাঠ্যবস্তুর অন্তর্ভুক্তিতে, যে প্রক্রিয়া ছাত্রসমাজের মগজধোলাই করবার উদ্দেশ্যেই করা বলে অভিজ্ঞ শিক্ষক মহলের ধারণা। এর পরে আমরা দেখা গেল বিভিন্ন স্থানের নামান্তরে অতিরিক্ত জোর দেওয়া হচ্ছে। এলাহাবাদ হয়ে গেল প্রয়াগরাজ, মুঘলসরাই হয়ে গেল দীনদয়াল উপাধ্যায়।
শেষোক্ত নামটি বিশেষ খেদের, কারণ এই মুঘলসরাই অঞ্চলেই বড় হয়েছিলেন ভারতের প্রাক্তন এক প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী। সেই প্রাজ্ঞ, বিচক্ষন এবং দেশরক্ষায় নিবেদিত মানুষটির পরিবর্তে আনা হলো এমন এক মানুষের নাম যার পরিচিতি এক উগ্র জাতিয়তাবাদী ধারণায় চালিত সংখ্যাধিক্যের মতবাদ প্রচারের জন্য স্বীকৃত এক সংগঠনের সদস্যই।
দিল্লীর মুঘল গার্ডেনকে এখন কতজন ‘অমৃত উদ্যান’ বলতে অভ্যস্ত হয়েছেন, জানা নেই। ঠিক তেমনই জানা নেই কতজনকে শ্যামাপ্রসাদ বললে তাঁরা কলকাতা বন্দরকেই চিহ্নিত করবেন।
কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা রদ হলো বটে, তবে পাকিস্থানের আতঙ্কবাদী হামলা থেকে কতদূর রক্ষা করা গেছে, অথবা সেখানে অন্য রাজ্যের ভারতীয় অধিবাসীরা কতজন ঠিকানা বদলে আছেন, অথবা শিল্পোদ্যোগে বিনিয়োগ করছে তা অধিকাংশ সাধারণ ভারতবাসীর কাছেই অজ্ঞাত।
এমনকি, চীনের যে আগ্রাসন নিয়ে দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর দিকে যেভাবে অভিযোগের আঙুল তোলা হয়েছে ইদানিং, সেই চীন ইদানিং যেভাবে আক্রমণ শানাচ্ছে এবং নতুন মানচিত্রে এলাকা নির্ধারণ ইত্যাদি বিষয়ে ভারতের প্রতিরক্ষা এবং বিদেশ মন্ত্রক যে বিশেষ সোচ্চার, তা কি বলা যায়? অন্তত, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের অবস্থান যতটা কঠোর, ততটা কি চীনের বিরুদ্ধেও রয়েছে?
দ্বিতীয়বার নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হওয়ার পর থেকেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে ভারতের সমাজে আর্থিক পীড়া যতই মাত্রা ছড়াচ্ছে, বিভাজনের ও মেরুকরণের প্রক্রিয়া ততই প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা নিচ্ছে। এমন অবস্থায় নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীনতা বা ইনকিউমবেন্সি-র লক্ষ্মণগুলিও প্রকট হচ্ছে।
সেই পরিপ্রেক্ষিতেই সংসদে ঘটমান বিশেষ অধিবেশনটি দেখা প্রয়োজন। শুরুর দিনে অধিবেশন চলাকালীন বিজেপির নেতা সমুদয় এবং নেতৃস্থানীয়রা যেভাবে পারস্পরিক বৈঠকে রত ছিলেন, তাতে বোঝা যাচ্ছে জনকল্যাণ স্বার্থের চেয়ে নিজেদের অস্তিত্বরক্ষার স্বার্থ তুলনামূলকভাবে বেশি।
সেফোলজিস্ট বা ভোটবিশেষজ্ঞদের কাছে ভারতে মহিলা ভোট এখন বিশেষ চর্চিত বস্তু ।
বিভিন্ন সেফোলজিক্যাল অঙ্কে দেখা যাচ্ছে মহিলাদের দেওয়া ভোট বিজয়ী এবং বিজিত ভোটপ্রার্থীদের কাছে নির্ণায়ক হয়ে উঠছে। এই প্রেক্ষিতে গতকাল যখন প্রধানমন্ত্রী দীর্ঘকাল ধরে ফেলে রাখা মহিলা সংরক্ষণ বিলটিকে উদ্যোগ নিয়ে মন্ত্রীসভায় অনুমোদন করিয়ে নেন, তখন মহিলাদের মন জয় করবার বিষয়টি আর উহ্য থাকে না।
লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচন ক্ষেত্রগুলির ৩৩ শতাংশ মহিলাদের জন্যে সংরক্ষিত হবে – এ অতি আনন্দের বিষয়। মহিলাদের সশক্তিকরণে এই সাংবিধানিক পদক্ষেপটি একান্ত জরুরি ছিল। তবে যে কৌশলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই বিলটিকে জনসমক্ষে এনে নতুন বিতর্কের সূচনা করলেন, তাতে সক্রিয় রাজনীতিতে মহিলাদের অংশগ্রহণ তো মান্যতা পাবেই।
তবে এই সাংবিধানিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে অন্য একটি প্রশ্ন। ভারতের পুরুষকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় এই মহিলারা কি চিরকালীন রীতি অনুযায়ী পুরুষদের অনুসারী হবে, না নিজেদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র বজায় রেখে রাজনৈতিক চলিত আখ্যান তথা কণ্ঠস্বরকে নতুন মাত্রা প্রদান করবেন?
বলা যেতে পারতে, আগামী দিনগুলিতে বিজেপি-র প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক আখ্যানকেন্দ্রিকতা নিজের অবস্থান বদলে লিঙ্গসাম্যের আখ্যানটিকে সামনে আনতে পারবেন কিনা, তা অত্যন্ত কৌতূহলপ্রদ বিষয় হয়ে উঠবে আসন্ন নির্বাচনের প্রচারে। কারণ, যে পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোয় সংখ্যাধিক্যবাদ তথা উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠানটি নাগপুর থেকে বিজেপি-র রাজনীতিকে চালনা করছে, তা কতটা প্রভাবিত হবে যদি দেশের নারীরা নিজেদের অধিকার এবং রাজনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থান নিয়ে সোচ্চার হয়ে ওঠেন?
নরেন্দ্র মোদী দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হওয়ার পরে মনোযোগ দিয়েছেন বিরোধী শক্তিকে বিভাজিত করবার প্রতি মনোযোগ দিয়েছেন। এই মনোযোগ যে কতখানি তা স্পষ্ট হয় যখন বিরোধী দলগুলি জোট বেঁধে নিজেদের ‘ইণ্ডিয়া’ নামে অভিহিত করে। তারপরে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে দেখা গেলম প্রধানমন্ত্রী ‘ভারত’ নামটিকে দেশের নাম বানানোর জন্যে কী পরিমাণ উদ্যোগ নিয়েছেন।
এই মনোযোগ এবং উদ্যোগের একটি অংশ যদি প্রধানমন্ত্রী যদি প্রকৃত অর্থে ‘দেশ কা বিকাশ’-এর জন্যে দিতেন তাহলে এত কথা বলবার সুযোগ থাকতো না। তিনি যদি জনকল্যাণের জন্য নিবেদিত এক প্রশাসন ব্যবস্থা নির্মাণ, আইন এবং সরকারের আইনি সংস্থাগুলিকে প্রতিহিংসামূলক আচরণ থেকে বিরত হওয়ার কাজটি যত্নসহকারে করতেন, তাহলে রাজ্যের পর রাজ্যে বিজেপি-র এই পরাজয় ঘটতো না।
দেশের যুক্তরাষ্ট্র কাঠামোটিকে সম্মান না দিয়ে উনি যখন সংকটকালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে এবং ‘এক দেশ এক ভোট’ স্লোগান তুললেন, বোঝা গেল, উনি অস্তিত্বের সংকটে ভুগছেন।
মরিয়া হয়ে এবার মহিলা সংরক্ষণ বিলটি কেন্দ্রসভায় অনুমোদন করিয়ে নেওয়ার এই সিদ্ধান্ত তাঁর এবং বিজেপি-র জন্যে ব্যুমেরাং প্রমাণিত হবে না তো?
Comments