top of page

‘বাংলা’-র আবেদনে রা নেই, অথচ ‘ভারত’ নিয়ে হুজুগ তুঙ্গে


পশ্চিমবঙ্গের নামকে ‘বাংলা’-তে বদল করবার প্রস্তাব বিধানসভায় পাস হয়ে গেছে ২০১৬ সালের ২ আগস্ট। এবং তার ভিত্তিতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ২০১৮ সালের ২৬ জুলাই ঘোষণাও করেন যে বাংলা, হিন্দি এবং ইংরেজি – এই তিন ভাষায় রাজ্যের নাম ‘বাংলা’ই হবে।


বাম-কংগ্রেসের সমর্থনে এই প্রস্তাবটিও অনুমোদিত হয়ে যায়। ৬ বছর কেটে গেলেও কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পাঠানো রাজ্যের তরফ থেকে রাজ্যের নাম 'বাংলা' করবার প্রস্তাব কিন্তু আজ অবধি গ্রাহ্য হলো না।


অথচ, রাষ্ট্রপতি দপ্তর থেকে অন্যান্য কেন্দ্রীয় সরকারের দপ্তর থেকে দেখা যাচ্ছে ‘গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া’ থেকে ‘গভর্নমেন্ট অফ ভারত’ কার্যকর করবার প্রক্রিয়ায় কোমর বেঁধে নেমে পড়েছেন নেতা, মন্ত্রী থেকে আমলা – সবাই।



সংবিধান অনুযায়ী, গণতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্র কাঠামোর ভিত্তিতে চলা এই দেশে এমন দ্বিচারিতার লক্ষণ বারবার ফুটে উঠছে দগদগে ঘায়ের মতো। এই বঞ্চনা এবং অপমানের প্রতিবাদে পশ্চিমবঙ্গের নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ অত্যন্ত ব্যথিত। তৃণমূল


পরিচালিত রাজ্য সরকার কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না যে পশ্চিমবঙ্গের নামান্তরের প্রক্রিয়াটিকে সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে বিশ বাঁও জলে ফেলে রাখা হয়েছে।


১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরে ১৯৭১ সালে ইস্ট পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে বাংলা প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরিত হয়। বাংলার পূর্ব ও পশ্চিম ভৌগলিক দিক নিরূপণে তখন সরকারী স্তরেই পশ্চিমবঙ্গের নাম নির্ধারিত হয়। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল অবধি যে পূর্ব বাংলার উল্লেখ সাহিত্য ও বিভিন্ন নথিতে পাওয়া যায়, তার প্রাসঙ্গিকতা বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির পরে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়।


শুধু রয়ে যায় সেই পশ্চিমবঙ্গ। ক্ষমতায় আসবার পর থেকেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই নামান্তরের বিষয়টি নিয়ে সোচ্চার হয়েছিলেন। এবং পরবর্তীকালে রাজ্য স্তরে আইন করে ‘বাংলা’ করবার প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণও করেন। অথচ, কেন্দ্রীয় সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলি থেকে অনুমোদন না আসবার কারণে তা আজ অবধি দেশে বা বিদেশে রীতিসম্মতভাবে কার্যকর হয়নি।



‘বাংলা’ নামটি নিয়ে আমাদের আবেগ অতি গভীর। এছাড়াও, প্রশাসনিক স্তর থেকেও ‘বাংলা’ নামটি ব্যবহারের অন্যান্য সুবিধাও কম নয়। ইংরেজি অক্ষর বিন্যাসে West Bengal-এর ‘W’-র স্থান কিন্তু ‘Bangla’-র ‘B’-র অনেকটা পরে। স্বাভাবিকভাবেই, কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের তালিকায় বাংলা-র স্থান অনেকটা উঁচুতে উঠে আসবে। নাম পরিবর্তনের ভিত্তিতে রাজ্যের উন্নতির লক্ষ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই সরল পদক্ষেপটির নেপথ্যে কোনো সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থের গন্ধ খোঁজা তাই অহেতুক।


অথচ, এই সংকীর্ণ ধর্ম-কেন্দ্রিক মানসিকতা, যা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস)-এর ঘোষিত ‘হিন্দুরাষ্ট্র’-র অনুসারী, তা আজ চর্চার শিরোপায় আনতে চাইছে বিজেপি এবং প্রধানমন্ত্রী। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে I.N.D.I.A নামের যে বিজেপি-বিরোধী জোট সৃষ্টি হয়েছে, তাকে আসন্ন সাধারণ নির্বাচন ২০২৪-এ প্রতিরোধ করবার এক দুর্মর প্রচেষ্টা।




‘ইন্ডিয়া’ নামটির প্রতি স্বাভাবিকভাবেই নরেন্দ্র মোদী সহ অন্যান্য বিজেপি-র নেতাদের যে ‘জাতক্রোধ’ জন্ম নিয়েছে তা কিন্তু সাম্প্রতিক। যখনই তাঁরা বুঝতে পারলেন যে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স নামে যে জুজু নির্বাচন আকাশে প্রকাশ করতে উন্মুখ, তখনই I.N.D.I.A.-র প্রতি তাঁদের অ্যালার্জি তৈরি হয়।


এই যে ‘প্রেসিডেন্ট অফ ভারত’ বা ‘প্রাইম মিনিস্টার অফ ভারত’ বলে তাঁরা নিজেদের সম্ভাষিত করতে চাইছেন জি-২০ সম্মেলনে, দেশেবিদেশের বোধবুদ্ধিযুক্ত মানুষদের কাছে তা ভারতের অবশিষ্ট সম্মানটুকুও হারানোর চিহ্ন হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। সেইদিক থেকে দেখ


লে প্রধানমন্ত্রী শুধুমাত্র তাঁর অভ্যাসমাফিক সংবাদের শিরোনামই সৃষ্টি করছেন না। ২০১৬ সালের নোটবন্দির মতো নিজেকে এবং দেশকেও ‘বিকাশ’-এর পথ থেকে সরিয়ে আনছেন।


দেশের সম্মানের কথা ভেবে I.N.D.I.A.-র নেতা-নেত্রীরা যদিও রাষ্ট্রপতির ডাকা নৈশভোজে যোগ দেবেন, তবে মনে রাখতে হবে এই মুহূর্তে সংবিধান অনুযায়ী, ‘প্রেসিডেন্ট অফ ভারত’ বা ‘প্রাইম মিনিস্টার অফ ভারত’ আদৌ গ্রাহ্য কোনো পদ নয়। সেই কথাই সিপিএম-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী মনে করিয়ে দিয়েছেন। অন্যদিকে, তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় টুইট করে জানিয়েছেন, “INDIA বনাম ভারত, এটা বি


জেপি-র বিভ্রান্তির চেষ্টা মাত্র। আসুন, আকাশছোঁয়া দাম, ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা, বেকারত্ব, সীমান্ত সমস্যা এবং ডবল ইঞ্জিন সরকার ও তার ফাঁকা জাতীয়তাবাদের বক্তব্যের জন্যে সরকারকে চেপে ধরি।”


সর্বোপরি, যে সিদ্ধান্ত নিলে বাংলার মানুষ তাঁকে চিরজীবন মনে রাখতেন, সেই রাজ্যের নামান্তর প্রক্রিয়াটিকে ত্বরান্বিত না করে তিনি সেই দীর্ঘকাল আগে উপস্থাপিত প্রস্তাবটির কথা সম্ভবত ভুলেই গেছেন। সেটাই স্বাভাবিক। কারণ এক, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি প্রধান বিরোধী দল শুধু সংখ্যার নিরিখেই। এবং দুই, আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই সূত্রে সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে চলে এলে তা নরেন্দ্র মোদীর পক্ষে আত্মঘাতী এক প্রচেষ্টা হিসেবে গণ্য হবে।


এবার কি পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি-বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা একজোট হয়ে পশ্চিমবঙ্গের নাম ‘বাংলা’-য় পরিবর্তনের জন্যে কেন্দ্রীয় সরকারের উপর আবার নতুন করে চাপ দেবেন?


Comments


bottom of page