লিখছেন সুমিত দাশ
বর্ষা শেষের দিকে। গৌরভাঙার আশপাশের জমি সবুজ হয়েছে। সামনে পুজো। তারপর কার্তিক-অঘ্রান, নতুন ফসল আর উত্তাপ কমার দিন। গ্রাম-শহর থেকে আসরের ডাক আসবে। গাইয়ে-বাজিয়েরা একন অনেকেই জমিতে। গৌড়ভাঙায় অবশ্য অন্য ছবি। ফোন করে হোক, না জানিয়ে হোক, গ্রামে পৌঁছে গেলে ফকিরবাড়ি ফেরায় না। ভক্তের আসন সর্বদা পাতা।
আজাহার ফকির, মানে মনসুর ফকিরের বাবাও ছিলেন গাইয়ে। একসময় সীমান্ত থাকলেও নদিয়া আর কুষ্টিয়ার মাঝে কাঁটাতার ছিল না। গাইয়েরা দুপারের আসরে যেতেন। স্হানীয় প্রশাসন লিখে দিলেই হতো। সময় যত গেছে, পররাষ্ট্র-আইন কঠিন হয়েছে। গান আর চাষাবাদ নিয়ে গৌরভাঙা রয়ে গেছে নিজের মত। বরং, গত দু'দশকে গাইয়ে ফকিরের গ্রাম হিসেবে পরিচিত পেয়েছে নতুন করে। এখানকার বাংলা কাওয়াল আরমান ফকির রীতিমত বিখ্যাত। তবে এ গ্রাম আসলে বিখ্যাত করেছেন মাধুকরী করা ফকিররা। এখানে ওখানে গাইতে গেছেন, পরম্পরায় গানের স্মৃতি ও সুর ধরে রেখেছেন। তারই ফলশ্রুতিতে আজো, গৌরভাঙার নতুন প্রজন্ম দোতারা আর ঢোলের তালিম নেয়। এ গ্রামে শ্রীচৈতন্যে বিলীন হন লালন সাঁই। আরমান ফকির, নূর আলম, আমিরুল ফকির, বাবু ফকির, লালচাঁদ, আক্কাস ফকিররা নতুন প্রজন্মে ছড়িয়ে দেন লালনের ধারা। আর এখন, এঁদের মধ্যে প্রবীনতম মনসুর ফকির।
হঠাৎই ফোন করলাম, সঙ্গে সঙ্গে অভিমান, 'আসো না কেন? আসো'! গৌড়ভাঙার এই ডাকে আজো নতুন প্রজন্ম ট্রেন-বাস ধরে, বা গাড়ি ছোটায়। 'মনসুরদা, ভোট আসছে গো!' কথার মাঝে খানিক থমকালেন গৌরভাঙার প্রবীনতম গাইয়ে। বললেন, 'চব্বিশে বিষ না নামালে মুশকিল। মহাপ্রভু, লালন, রবীন্দ্রনাথকে বাঁচাতে হবে। সাম্য চাই, শান্তি চাই, বিভাজন আর সয় না।'
দিনভর ভক্তের আনাগোনা, আজাহার ফকিরের মাজারে গান থামে না। শনি-রবি হলে, সকালে-সন্ধ্যায় রান্নাবান্না একটু বেশিই করতে হয়। এর মাঝে কথা হচ্ছিলো আমাদের।
''আজকাল চাঁদের গায়ে সবার মন, দেশের বিজ্ঞানীরা অসাধ্য সাধন করলো। অথচ দেখো, নিচে কত হিংসা, রক্ত, বিভাজন। ভোট আসছে, সম্প্রীতির মানুষ, মিলনের মানুষের মধ্যেও কেমন বিভাজন হয়ে গেছে। চাঁদ দেখার বিভাজন তো ছিল না গোসাই!'' প্রবীন মনসুরের গলা ভারী হয়।
কথায় কথায় আসে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের প্রসঙ্গ। বললেন, ''গৌরভাঙা সেই কবে থেকে চৈতন্যে বিলীন হয়েছে। এখানে কীর্তনে মেশেন লালান সাঁই। মহাপ্রভুতে বিলীন হন মহম্মদ। এটা বাঁচাতে হবে। ২৪-এর লোকসভা নির্বাচন আসলে ভারতবর্ষের ভাগ্যের লড়াই।''
মহাপ্রভু বিভাজন বাঁচাতে গিয়ে খুন হন, লালন লাঞ্ছিত, পঁচিশে বৈশাখ মুছে যাচ্ছে, মুছে যাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। নাগারে বলতে বলতে ফকির মনসুর বলে ওঠেন ''বিষাক্ত বিভাজনের এই ভোট আসলে চৈতন্য-লালান-রবীন্দ্রনাথ বাঁচানোর লড়াই। নইলে পাকাপাকি সম্প্রীতি মিথ্যা হবে। মিলনের গান, আমাদের সংস্কৃতি, ভাষা সব হারাবে। সংস্কৃতি বড় আক্রান্ত যে।''
সময়টা মিডিয়ার, মিডিয়া যেমন খাওয়ায়, সরল মনে সেসবই খায় বিভাজিত মানুষ। মনসুরের আক্ষেপ হতাশায় বদলায়। কঠিনতম নির্বাচন আসন্ন, খানিক কথা বলার গতি কমিয়ে ফকির বলেন, -"শান্তি আর সম্প্রীতির সাধনা করি আমরা। কী বলো, পারবো না আমরা, এ লড়াই তো ভারতবর্ষের সবার, তাই না!"
আসন্ন নির্বাচন যে কঠিনতম, তা নিয়ে সংশয় নেই। গত এক দশকে বাউল-ফকিরদের মধ্যেও বিভাজন হয়েছে বিস্তর। পশ্চিমবঙ্গের বাউলদের একটি সংগঠন - বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে চিন্তিত হলেও, ভারতে সংখ্যালঘু, দলিত বা শিল্প-সংস্কৃতি আক্রান্ত হলে চুপ করে থাকে। চরম বিভাজনের মধ্যেই তো গায়ে গা ঘষিয়ে সংকীর্তনের ডাক দিয়েছিলেন শ্রী চৈতন্য, প্রবল হিন্দু-মুসলিম বিবাজন আর জাতপাতের মাঝে উদাস হয়ে মানবতায় বিলীন হয়েছেন লালান, রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমস্ত সৃষ্টি দিয়ে বেঁধে রাখতে চেয়েছিলেন বিস্তীর্ণ-বাংলাকে। মনসুর এ সবই নিজের মত করে জানেন। ভাবে সুর আর দোতারার চলন এক হলে এখনও টেলিফোনের ওপারে, গৌরভাঙার আলে বা শহর কলকাতার মঞ্চে গেয়ে উঠতে পারেন, -"এমন মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে/ যবে হিন্দু,মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান জাতি-ধর্ম নাহি রবে।"
মনসুর ফকির জানেন বিষটা কী? তিলে তিলে কতটা তীব্র-মারক হয়েছে সে বিষ। না থামালে যে আগামীতে ভারতবর্ষ নামক ধারণাটি বিপন্ন, নানা কথায় বুঝিয়ে দিলেন গৌরভাঙার ফকির।
Comments