লেখক - সুমিত দাস, সাংবাদিক
'ময়ূরী সঙ্গম না করে স্রেফ চোখের জলেই গর্ভবতী হয়।' হিন্দি চ্যানেলে ভেসে আসা এই 'গুরুবাণী' আজকাল বাংলার কোনও কোনও কীর্তনীয়া আসরে বাসরে বলেন। পিছনে তখন বাজতে তাকে বেহালা, খোল, বাঁশি। শ্রীশ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর সময় থেকে চলে আসা কীর্তন, সংকীর্তন আসলে বর্ণাশ্রমের বেড়া ভেঙে গায়ে গা ঘষার আয়োজন। অথচ, জাতপাত ও বর্ণাশ্রম ঠিক তার উল্টো। বিভাজন ও দূরত্বই তাতে কাম্য। উঁচু ও নিচু, মানব সমাজে এই বিভাজন আসলে ধর্ম অর্থে ন্যায় বিরোধী। আর এই 'ন্যায় ও সাম্য' হল শ্রী চৈতন্যের সাধনা ও সংগ্রামের পথ।
ইদানিং, কীর্তনের আসরে শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতের পদ বিশ্লেষণ শুরু করেছেন কীর্তনীয়া দীনকৃষ্ণ ঠাকুর। মূল পদবী নস্কর। বছর চল্লিশের দীনকৃষ্ণের বাড়ি দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার জয়নগর থানার হাটচাপড়ি গ্রামে। বৈষ্ণব পরিবারের সন্তান দীনকৃষ্ণ আসলে ঐতিহাসিক চৈতন্যের হদিশ দিতে চান। ইতিমধ্যে দক্ষিণ ২৪ পরগণায় তাঁর জনপ্রিয়তা ক্রমেই বাড়ছে। মঞ্চে বা আখরায় দীনকৃষ্ণের বক্তৃতায় যেমন শ্রোতা বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিরোধীপক্ষ।
কীর্তনের আসরে ব্রাহ্মণ্যবাদ, বর্ণবাদ, জাতপাত-বিরোধী অবস্হান দেখা যায় না। অন্তত, সমসাময়িক কারো স্মৃতিতে আছে বলে শোনা যায় না। দীনকৃষ্ণ আসরে আসরে পুরান, শাস্ত্র, কাব্য, পুরোহিত দর্পণের ফারাক বেঝান। ফারাক বোঝান বিশ্বাস ও আরোপের । ইউটিউবে দীনকৃষ্ণ ও তাঁর বিরোধী পক্ষের মতামত ও অবস্হান নিয়ে ভিডিও রোজই বাড়ে। নানান আসরে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বিরোধীদের তর্কসভায় বসার ডাক দেন। কিন্তু, দীনকৃষ্ণের বিরোধীর সংখ্যা বাড়লেও, তর্কে সামিল হন না তারা।
কেন বাড়ছে দীনকৃষ্ণের জনপ্রিয়তা? বাংলায় দলিত আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা শরদিন্দু উদ্দীপন বলেন, -'এর কারণ ঐতিহাসিক'।
"বাংলার নবাব হুসেন শাহ (১৪৯৪-১৫১৯) রামচন্দ্র নস্করকে সেনাধ্যক্ষ নিয়োগ করেছিলেন। প্রায় ১৫ হাজার সেনার নেতা রামচন্দ্র নস্কর ছিলেন বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের। সমসাময়িক বিশ্বম্বর মিশ্র (১৮৮৬-১৫৩৫) অর্থাৎ, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর অন্যতম ভক্ত ও সেনা অর্থে 'নস্কর-সমাজ' ছিল বর্ণবাদ ও ব্রাহ্মণবাদ বিরোধী। চৈতন্যের চর্চা ও লড়াইয়ের বিষয় ছিল 'আচণ্ডাল প্রেম' মানে সাম্যবাদ ও জাস্টিস মানে ন্যায়। এই হুসেন শাহের অনুরোধে পুরীর রাজা রুদ্রপ্রতাপের কাছে আশ্রয় পান মহাপ্রভু। পরে বর্ণবাদীদের হাতে ৪৮ বছর বয়সে খুন হন চৈতন্য।" শরদিন্দু উদ্দীপনের এই বক্তব্যে দক্ষিণ ২৪ পরগণার বিভিন্ন অঞ্চলের বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের বিশ্বাস ও ভাবনা মেলে। আর, দীনকৃষ্ণ ঠাকুর (নস্কর) তাদেরই প্রতিনিধি।
শ্রীচৈতন্য পরবর্তী চারটি ধারা ১) নিতাই বাড়ি, ২) নবদ্বীপ, ৩) বাঁকুড়া ও ৪) আধুনিক ইসকন - শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতের পথে সে অর্থে নেই। কারো কারো অভিযোগ, নবদ্বীপ থেকে মায়াপুরে চৈতন্য ও বৈষ্ণবের মূল ইতিহাস সরিয়ে নিয়ে যেতে উদ্যোগী ইসকন। সেক্ষেত্রে তারা নাকি অনেকটাই সফল।
চৈতন্যে্র আচণ্ডাল প্রেম ও সাম্য বাংলার কীর্তনের আসরে নামিয়ে আনছেন দীনকৃষ্ণ। সঙ্গে যুক্তিবাদ। প্রকৃতিধর্ম ও তার সনাতনী লোকাচারের মধ্যে শোষণ ও কুসংস্কার খুঁজে বের করছেন বছর চল্লিশের তরুণ।
একটা বিষয় পরিষ্কার। শহর বা মহানগর থেকে দূরে এক অচেনা লড়াই শুরু করেছেন দীনকৃষ্ণ। বিশ্বাস ও ভক্তি সঙ্গী করে তাঁর বিরোধীপক্ষ বাড়লেও, আসরে শ্রোতা বাড়ছে রোজ। হিন্দি চ্যানেল, বাংলা ভাষায় বাড়তে থাকা সংস্কারী গুরুদের ভিড়ে দীনকৃষ্ণের আসরে জাতপাতহীন সাম্যের পৃথিবী পান শ্রোতারা। হয়তো, শ্রীচৈতন্য এমনই পৃথিবী চেয়েছিলেন।
Comentarios