top of page

নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন বিজেপি কি ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকেই মানতে চাইছে না?


পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট যখন শাসনে ছিল, প্রায়ই বাম নেতা এবং মন্ত্রীদের মুখে অভিযোগ শোনা যেতো, ‘কেন্দ্র দিচ্ছে না’। বরাদ্দ টাকা পাওয়ার পরে, ‘পেয়েছি’ কথাটি জনসমক্ষে বিশেষ শোনা যেতো বলে মনে পড়ে না।


পরবর্তীকালে, নির্বাচিত হওয়ার পরে পশ্চিমবঙ্গ শাসন ক্ষমতা তৃণমূল কংগ্রেসের কাঁধে ন্যস্ত হয়। তখনও মুখ্যমন্ত্রী একই অভিযোগ বিভিন্ন সময়ে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ করেছেন। তবে ২০২২-এ কোভিড অতিমারির পরে কেন্দ্রীয় সরকারের বঞ্চনার মাত্রা ক্রমশ বেড়েছে বই কমেনি।


এমনটা যদি হতো যে নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহ চালিত বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা বা উন্নতি বিষয়ে একেবারেই উৎসাহী নয়, তাহলে বঞ্চনার মাত্রাটিকে অজ্ঞতা বা অবহেলা বলে ধরা যেতো। কিন্তু ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী এবং অমিত শাহ যেভাবে পশ্চিমবঙ্গে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করতেন তাতে এমন ধারনার কোনো ভিত্তিই নেই।


বস্তুত, ‘ডবল ইঞ্জিন সরকার’ নামে যে তত্ত্বটি বিজেপি-র নেতারা উদ্ভাবন করে সেই কোভিড অতিমারির মধ্যেও প্রচার করেন, তা সহজে ভোলবার নয়। বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি-র যে শোচনীয় পরাজয়টি ঘটে, তা থেকেই স্পষ্ট হয়েছিল, নরেন্দ্র মোদী নামে যে ছাপ্পান্ন ইঞ্চি পাথর বিজেপি-কে আগলে রেখেছিল, তাতে বেশ বড় ফাটল ধরেছে।


নির্বাচনের ফলাফল থেকেই প্রমাণ যে নরেন্দ্র মোদীর প্রতি আকর্ষিত হয়নি পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী, নরেন্দ্র মোদী দেশের প্রধানমন্ত্রী। সুতরাং ব্যক্তি নরেন্দ্র মোদীর আবেদন খারিজ করার জন্যে প্রতিহিংসামূলক মনোভাব মোটেই প্রধানমন্ত্রীসুলভ আচরণ নয়। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রায় প্রতিটি পদক্ষেপেই এই প্রতিহিংসা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।


পশ্চিমবঙ্গে নিয়োগ-সংক্রান্ত দুর্নীতির বিরুদ্ধে আদালত এক অনমনীয় অবস্থান নিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গবাসীর জন্যে তা স্বস্তিদায়ক। কিন্তু মহামান্য আদালত যে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাদের হাতে এই দুর্নীতির তল সন্ধানের দায়িত্ব দিয়েছে, তার সক্রিয়তা এবং নিষ্ক্রিয়তা দুটোই যথেষ্ট সন্দেহজনক। সম্প্রতি বিচারপতি অমৃতা সিনহা যেভাবে সিবিআই-এর তদন্তকারী অফিসার এবং অধিকর্তাকে ভরা আদালতে ভর্ৎসনা করলেন, তা থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্থাদের গতিপ্রকৃতি নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ তৈরি হয়েছে।


তবে ২০০৫ সালে পাস হওয়া মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান গ্যারান্টি স্কিম (সংক্ষেপে মনরেগা) নিয়ে যে কাণ্ডকারখানা মোদী সরকার শুরু করেছেন, তা দেখে যে কোনো ভুক্তভোগীর কাছেই বিষয়টা স্পষ্ট। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী গ্রামীণ পরিবারের প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক সদস্যকে ১০০ দিনের কম কায়িক অদক্ষ পরিশ্রমে নিযুক্ত করা হয়।


দীর্ঘ সময় ধরে এই মনরেগা খাতে কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দ টাকা পশ্চিমবঙ্গ পাচ্ছে না। এবং তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, এই বিষয়ে প্রশ্ন তুললে আগে হিসেব ঠিক করবার কথা শোনাতেন বিজেপি নেতারা। ইদানিং কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী গিরিরাজ সিং তৃণমূল নেতাদের কাছাকাছি দেখলেই পালিয়ে যাচ্ছেন।


বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ হিসেবে গিরিরাজ সিং-এর এটুকু বোধ আছে যে উনি এখন শাঁখের করাত। প্রধানমন্ত্রী এবং বিজেপি-র নির্দেশে ওনাকে এখন তৃণমূল কংগ্রেসকে ‘টাইট’ দেওয়ার জন্যে এই বঞ্চনার পথ বেছে নিতে হয়েছে। কিন্তু সংবিধানের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এক মন্ত্রী হিসেবে উনি ভালোই জানেন যে পশ্চিমবঙ্গের বিরুদ্ধে অন্যায় হচ্ছে, এবং উনি অসহায়ের মতো তা হতে দিচ্ছেন।


পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীও দেখছেন এই ক্রমবর্ধমান আর্থিক মন্দার মধ্যে বিভিন্ন প্রকল্প বাবদ মোট ১ লক্ষ ১৫ হাজার কোটি টাকা পাওনা রয়েছে, যার মধ্যে মনরেগা এবং আবাস যোজনা প্রকল্পে প্রাপ্য ১৫ হাজার কোটি টাকা। এই বিশাল পরিমাণ অর্থ না মেটালে পশ্চিমবঙ্গে যারা সবচেয়ে বেশি অসুবিধায় পড়বেন, তাঁরা গ্রামের গরীব পরিবার।


তৃণমূল কংগ্রেস যে বকেয়া টাকা আদায়ের জন্যে চাপ দেবেন, তা মোদী সরকার ভালোই জানতেন। কিন্তু অত্যন্ত ধূর্ত ব্যক্তির মতো তিনি শেষ সময় অবধি অপেক্ষা করেছেন। রেলের জন্যে আগাম টাকা নিয়ে শেষ মুহূর্তে রেল যাতে না পাওয়া যায়, তা নিশ্চিত করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর আসনটিকেই উনি অপদস্ত করছেন বারবার।


বাংলায় একটা কথা আছে, নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ। কিন্তু তৃণমূল নেত্রী যে এত সহজে রণে ভঙ্গ দেবেন না, তা হয়তো উনি আন্দাজ করতে পারেন নি। ঠিক যেভাবে উনি আন্দাজ করতে পারছেন না, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে অপদস্ত বা তাঁর আত্মীয়কে ব্যতিব্যস্ত করলেই জনগণের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধেই পশ্চিমবঙ্গবাসীর রোষ ঘনীভূত হবে।


সম্ভবত ‘ডবল ইঞ্জিন সরকার’ নামক আজব ধারণাটি থেকে বার হয়ে আসতে পারছেন না নরেন্দ্র মোদী। ভাবছেন দিনের পর দিন মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর আত্মীয়ের নামে কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি এবং অপমানজনক এত কথা বলে প্রচার করেও উনি পশ্চিমবঙ্গবাসীর মন পেলেন না। তাই রাজ্য ছারখার হয়ে যায় তো যাক। এমনটা ভাবলে কিন্তু উনি ভারতের সংবিধান-প্রদত্ত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোটাকেই অস্বীকার করছেন প্রতিটি পদক্ষেপে।

Comments


bottom of page