top of page

‘ইন্ডিয়া’ না ‘ভারত’ – প্রশ্নটি কালচিহ্নের মতো দেশের সামনে ঝুলছে

আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের দিকে চোখ রেখে কংগ্রেস সহ ২৬টি আঞ্চলিক দল গত ১৮ই জুলাই ক্ষমতাসীন বিজেপি-র বিরুদ্ধে একটি জোট সৃষ্টির ঘোষণা করেন। জোটটিকে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলেপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স বা সংক্ষেপে I.N.D.I.A. হিসেবেই সংবাদমাধ্যম অভিহিত করতে থাকে প্রথম দিন থেকেই। কিন্তু ক্ষমতাসীন বিজেপি সর



কার এই নামে সিঁদুরে মেঘ দেখতে পেলেন।


উপর্যুপরি আক্রমণে ‘কুইট ইণ্ডিয়া’ ইত্যাদি বাছা বাছা শব্দপ্রয়োগে ক্ষান্ত দিলেন না প্রধানমন্ত্রী সহ তাঁর অনুগামীরা। দেওয়ার উপযুক্ত কারণও ছিল। গত নয় বছরে ‘ইণ্ডিয়া’ নামটিকে প্রায় মালিকানাধীন করে নিয়ে উন্নয়নমূলক

প্রচার চালিয়েছেন বিসব-দরবারে। বস্তুত, নতুন দিল্লীতে আসন্ন জি-২০ সম্মেলনের সভাপতি দেশ হিসেবে ইন্ডিয়া’র প্রধানমন্ত্রী শিশমহল-সুলভ গজদন্ত মিনার থেকে বিশ্বগুরুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে তাঁর নেতৃত্বে দেশ কত এগিয়েছে তা জগৎকে জানিয়ে নিজের ঢাক নিজেই পেটাবেন।

অথচ, মজার বিষয়, জি-২০ সম্মেলন উপলক্ষ্যে অতিথিবর্গ এবং অন্যান্যদের নামে যে রাষ্ট্রীয় নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদি মুর্মু, সেই চিঠির প্যাডে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা হয়েছে ‘দ্য প্রেসিডেন্ট অফ ভারত’। এতদিন জানা ছিল, ‘ইণ্ডিয়া’ শব্দটি পাশ্চাত্যের তাই পরম্পরাগত চলিত ভাষায় ভারত বা ভারতবর্ষ বললে ভাষার সাযুজ্য রক্ষা হয়। কিন্তু রাষ্ট্রপতির এই নতুন লেটারপ্যাডে ইংরেজি ভাষায় ‘প্রেসিডেন্ট’ এবং ‘ভারত’ শব্দদুটির সোচ্চার ব্যবহারে দেশবাসীর মনে যে প্রশ্নটি আলোড়ন তুলছে তা হলো ‘ইন্ডিয়া’ থেকে ‘ভারত’-কে বিচ্ছিন্ন করতে তৎপর ক্ষমতাসীন বিজেপি দল?


গত ৯ বছর ধরে নেপথ্যে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস)-এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগে যে দেশের বিভিন্ন নীতি এবং প্রশাসন – এমনকি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা

ও চালিত হচ্ছে, এমনটা প্রতীত হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষদের ধারণাতেও। অবশ্য আরএসএস বিভিন্ন অনুষ্ঠানে জনসমক্ষে এই ধারণা ‘ভুল’ বলে দাবি তুলেছে। অর্থাৎ সরাসরি এই সংস্থা দেশীয় নীতি নির্ধারণ ও কার্যায়নে ‘নাক ঘামায় না’ – এমন অবস্থানে তারা অনড়।


অথচ নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধন অনুষ্ঠানে দেশের রাষ্ট্রপতির আদিবাসী পরিচয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী যে সনাতনী পদ্ধটিতে উদ্বোধনটিকে যেভাবে দৃষ্টিকটু করে তোলেন তাতে বিশ্বের কাছে ভারতের ‘গণতান্ত্রিক’ তকমাটি যে কলঙ্কিত হয়েছে, তা অস্বীকার করে লাভ নেই। এবং এই কথাও স্পষ্ট হয়েছে যে ‘আড়ালে আছে আরএসএস’। ‘ইন্ডিয়া’ থেকে ‘ভারত’-এর এই পশ্চাৎযাত্রায় যে নব ইতিহাস নির্মাণের প্রয়াস ফুটে উঠছে, তা নথিভিত্তিক ইতিহাস রচনায় যথেষ্ট বিভ্রান্তির সৃষ্টি করবে, এমনটাই ইতিহাসবিদদের অভিমত। কারণ ভারতীয় সংবিধানে এই কথাগুলি স্পষ্ট লেখা আছে ‘ইন্ডিয়া দ্যাট ইজ ভারত’। কিন্তু শুধু ‘ভারত’ নয়, ইন্ডিয়ার সঙ্গে যুগ্মভাবে ব্যবহার হচ্ছে, যেমন হল্যান্ড এবং নেদারল্যান্ড আলাদা আলাদা হিসেবে মানচিত্রে তথা সেই দেশের অধিবাসীদের স্থান নেই।


পারস্য, বার্মা, কম্বোডিয়া, সিলোন, রোডেসিয়া প্রভৃতি দেশগুলি যখন নিজের দেশের নাম পরিবর্তন করে, তখন তার মধ্যে স্থানীয় জনমানসের আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়েছে। অথচ অ্যাপার্থাইড-মুক্ত দেশে বর্তমানে প্রয়াত নেলসন ম্যান্ডেলা জেল থেকে মুক্তি পেয়ে দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পর কই, দক্ষিণ আফ্রিকার নামটি তো বদলানোর কথা একবারও ভাবেননি। উল্টে, আফ্রিকা নামের মহাদেশের সঙ্গে নিজের শিকড়ের সংযোগকে উদযাপন করবারই কথা উনি বারবার বলে গেছেন।


তাহলে প্রশ্ন উঠছে, ‘ভারত’-এর মধ্যে যে সাবেকী ভাব রয়েছে তার প্রতি বিশ্বগুরু কি সত্যিই যত্নশীল। মনে হয় না। সনাতনী নামকরণ দিয়ে সস্তা রাজনীতি করে নির্বাচনী তরী বয়ে তীরে আনা ছাড়া আর কোনো কিছুই তাঁর উদ্দেশ্য নয়। দেশ ‘ভারত’ হোক বা ‘ইন্ডিয়া’ তাতে ওনার বা ভক্তদের কিছু যায় আসেনা। শুধু I.N.D.I.A. নামের জোটটি যেন আসন্ন নির্বাচনে তাঁর তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রীর অভিষেককে ম্লান না করতে পারে বা স্মভাবনাটুকুই বাতিল না করে দিতে পারে, সাধারণ মানুষদের ভোটের জোরে, তা নিশ্চিত করবার প্রতিই তিনি যত্নশীল।


এই প্রেক্ষাপট থেকে এই বিতর্কটিকে দেখা প্রয়োজন। কারণ, বর্তমান রাজনীতিতে ‘ভোটে জেতা’-টাই যদি মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে একথা স্পষ্ট যে ভারতের রাজ্যগুলিতে, বিশেষ করে দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে বিজেপি তথা মোদীর ‘সবকে সাথ, সবকে বিশ্বাস’ স্লোগান ইতোমধ্যেই ম্লান হচ্ছে। সত্যি কথা বলতে কি, বিরোধী জোট হিসেবে যে I.N.D.I.A.-কে চিহ্নিত করা হচ্ছে, তা প্রধানমন্ত্রীর যে নেতিবাচক প্রতিচ্ছবিটা সর্বসমক্ষে তৈরি হয়েছে, তাঁর বলেই বলিয়ান। এবং বিজেপি-র প্রতি মানুষের যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে, তা জি-২০ সম্মেলনের সভাপতিত্ব অথবা চন্দ্রযানের সাফল্য ইত্যাদি বলে প্রশমিত করা যাবে না।


তাই I.N.D.I.A. কথাটিকেই মানুষের মন থেকে মুছে দিতে হবে। ‘আমরা তো ভারত, উপনিবেশিক ইন্ডিয়া আজ অতীত’ – এমন যুক্তি দিয়েই ঘুঁটি সাজানো হবে আসন্ন লোকসভার নির্বাচনে। আগামী ১৮ই সেপ্টেম্বর সংসদে দুটি কক্ষে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে গঠিত কমিটির ‘এক দেশ এক ভোট’ সংক্রান্ত রিপোর্ট পেশের পর থেকেই।


প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, ২০১৬ সালে সংবিধানের ১ নম্বর ধারাটি সংশোধনের জন্যে যে জনস্বার্থ মামলা রজু করা হয়েছিল তা খারিজ করে সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, ‘ইন্ডিয়া হোক বা ভারত, যে কোনো নামে ডাকবার স্বাধীনতা দেশবাসীর আছে।’ এখন আমাদের দেখতে হবে আরএসএস-চালিত ভারতে এবার কি ‘মনুসংহিতা’ আইন প্রণয়নে প্রধান্য পাবে, নাকি ভারতের সংবিধান। অথবা, এমনটাও হতে পারে, সংবিধানের নামে মনুসংহিতার শ্লোক উচ্চারণ করেই আদালতগুলিতে পরবর্তীকালে সওয়াল-জবাব চলবে উপবীত-পরনে টিকিধারী পণ্ডিতদের সভাপতিত্বে।


(এই লেখা একান্তভাবেই লেখকের নিজস্ব ভাবনা ও চিন্তাধারা। হোয়াট্স দ্য নিউজ ডট কম-এর এই লেখার ভাবনা বা লেখকের চিন্তাধারার কোনও দায়ভারে আবদ্ধ নয় )

Comentários


bottom of page