ইউনেস্কো সম্প্রতি শান্তিনিকেতনকে ‘লিভিং হেরিটেজ’ তকমা দিয়ে বিশ্ব হেরিটেজ সাইটের তালিকায় সামিল করেছে। জানা গেল, কর্ণাটকের হয়সালা ‘পবিত্র সমাবেশ’ (সেক্রেড এন্সেম্বল)-ও এই তালিকাভুক্ত হয়েছে ২০২৩-এর সেপ্টেম্বরে। ভারত জুড়ে এখন ইউনেস্কোর ৪১টি বিশ্ব ঐতিহ্য সংরক্ষণ রয়েছে আপাতত।
গত বছরে তপতী গুহ ঠাকুরতার গবেষণা এবং উপ্সথাপ্নার উপর ভিত্তি করে পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপূজাকে ‘অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ (ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ) হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর থেকেই ঐতিহ্য এবং পরম্পরার দিকটি নিয়ে বাঙালি নতুন করে গুরুত্ব দিতে শুরু করলেন।
খুবই ভালো কথা! কারণ দুর্গাপুজো নামে যে রং ও সৃষ্টির উৎসব এই বাংলায় উদযাপিত হয়, তার জন্যে শহরের আবালবৃদ্ধবনিতাই যে পুজোর কয়েক মাস আগে থেকেই অপেক্ষা করতে থাকেন, তা নয়। গ্রামের দক্ষ কিন্তু কারিগর সমাজও কবে দুটো বেশি টাকা ঘরে আসবে মণ্ডপসজ্জায় দিনমজুরি খেটে, তার জন্যে উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষায় থাকেন।
দুর্গাপূজার নিজস্ব একটা গতি আছে, তার ছন্দতেও বৃষ্টি,বাদল এমনকি অতিমারিও তার উদযাপনে বিশেষ বিঘ্ন সচরাচর ঘটে না। কিন্তু একই কথা কি শান্তিনিকেতনের ক্ষেত্রে খাটে? কটু শোনালেও বলতে হবে, না।
১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন তাঁর পিতৃপ্রদত্ত জমিতে ‘ব্রহ্মচর্যাশ্রম’ প্রতিষ্ঠিত করেন, অধিকাংশ বাঙালি তখন নাক সিটকে ছিলেন। প্রথমত, ব্রাহ্ম বলে রবীন্দ্রনাথের প্রতি সেই সময়ে বাঙালির ভক্তি বিশেষ ছিল না। ঠাকুর বাড়ির রবিবাবু কবিতা লেখেন, গান রচনা করেন, সম্পাদনাও করেন, ব্যবসায় ব্যর্থ হন, বাবার জমিদারি দেখাশোনা করেন – অর্থাৎ, সচেতন ভাবে বাঙালি ঠাকুরবাড়ির এই ‘খেয়ালি’ সন্তানের থেকে সযত্ন দূরত্ব বজায় রেখে এসেছেন।
সত্যি কথা বলতে কি, বাঙালির থেকে রবীন্দ্রনাথের বিশেষ কিছু পাবার ছিল না। বিভিন্ন সময়ে উনি এই বিষয়ে আক্ষেপ করেছেন। তবে বিস্ফোরণ ঘটেছিল একবারই। সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্তির খবর শুনে যখন উৎসাহী বাঙালিদের একাংশ রবীন্দ্রনাথকে সম্বর্ধনা দেবেন বলে ট্রেনে চেপে বোলপুরে পৌঁছান।
মালা, সন্দেশ প্রভৃতি সম্বর্ধনার উপকরণ দেখে রবীন্দ্রনাথ ক্ষেপে বোম। ব্রিটিশ লেখক, কবি, অনুবাদক এবং রবীন্দ্রনাথের এক জীবনী রচয়িতা ই পি টমসন সশরীরে ওখানে সেই সময়ে রবীন্দ্রসমক্ষে ছিলেন। তাই রবীন্দ্রনাথের হুবহু কথাগুলিকে তিনি তাঁর বইতে বিবৃত করেন, “আপনারা কী চাইছেন বলুন তো? কুকুরের লেজে দড়ি বেঁধে তাতে কৌটোর পর কৌটো লাগিয়ে তাড়া করলে রাস্তায় ঠং ঠং করে ঘসা কৌটোগুলির শব্দে যেমন আমোদ পান, তেমন আমোদ চাইছেন আমার থেকে? আমি আপনাদের ইচ্ছা পূরণ করতে পারছি না।
পরবর্তীকালে অবশ্য রবীন্দ্রনাথ ই পি টমসনের জীবনীটিকে ‘সত্যনিষ্ঠ নয়’ বলে অনুমোদন দেননি। বাঙালির তিনি তখন ‘গুরুদেব’। এবং বাঙালির গুরুদেব বলেই তাঁকে সব দিক বিবেচনা করতে হয়েছিল। প্রায় সর্বস্ব দিয়ে উনি গড়ে তুলেছিলেন শান্তিনিকেতন বিশ্বভারতী। মৃত্যুর আগে মহাত্মা গান্ধীকে চিঠি লিখিয়ে অনুরোধ করেছিলেন “জীবনে যা কিছু পাথেয়, তা শান্তিনিকেতন নামে এই নৌকাতেই বোঝাই করেছি। মিনতি সহ আবেদন রাখছি, আমার মৃত্যুর পরে এই নৌকাটিকে ডুবতে দেবেন না।”
শান্তিনিকেতন ডোবেনি, তবে দিনে দিনে জীর্ণ হয়েছে। গত শতকের আটের দশকে যে শান্তিনিকেতন সর্বপ্রথম দেখেছিলাম, নতুন শতাব্দীর প্রথম দশকের মধ্যভাগে তার আত্মা জীর্ণ থেকে জীর্ণতর হতে দেখেছি। এক প্রখ্যাত বর্ষীয়ান আশ্রমিক অতি দুঃখে বলেছিলেন, “শান্তিনিকেতনটাই তো বীরভূম জেলার একমাত্র ইন্ডাস্ট্রি।” মন থেকে মেনে নিতে পারিনি তখন, কিন্তু ক্রমশ বুঝেছি ওনার দীর্ঘকালের পর্যবেক্ষণ বড় বেদনাদায়ভাবে সঠিক।
শান্তিনিকেতনকে ইউনেস্কো যে হেরিটেজ ট্যাগ দিচ্ছে, তা আশ্রম এলাকা, উত্তরায়ণ এবং কলা ভবনে সংলগ্ন এলাকাটিরই জন্যে প্রযোজ্য হবে। এবং তাৎপর্যপূর্ণভাবে শান্তিনিকেতনের অনন্য পঠনপাঠন পদ্ধতিটিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি, যার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের উন্মুক্ত শিক্ষাভাবনা একদা প্রতিফলিত হয়েছিল। নিজের সীমারেখা বজায় রেখেই ইউনেস্কো শুধু এর শৈল্পিক অস্তিত্বটুকুকেই মান্যতা দিয়েছে।
হেরিটেজ তকমার যুক্তি হিসেবে ইউনেস্কো ঘোষণা করেছে যে শান্তিনিকেতন ভবন, ম্যুরাল, ভাস্কর্য এবং নক্সার মধ্যে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের এশিয়ান আভা-গার্দ শিল্পের এক জাগ্রত প্রদর্শন খুঁজে পাওয়া যায়।
“বৈশ্বিক অন্বেষণে যার মধ্যে আধুনিকতা সূচিত হয়েছে,” বলে ইউনেস্কো-র ঘোষণা।” অর্থাৎ, বিশ্ববাসীর কাছে শান্তিনিকেতন বললে যে শৈল্পিক চেহারাটা ভাসে, ইউনেস্কো সেটুকুরই স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু বাঙালি তথা ভারতীয়দের একাংশের মধ্যে শান্তিনিকেতন বললে যে আবেগে র সঞ্চার হয়, তা কি আর অবশিষ্ট রয়েছে?
ইউনেস্কো যে সাইট (স্থান)-গুলিকে বিশ্ব ঐতিহ্য বলে মান্যতা দেওয়ার কথা ভেবেছে, প্রত্যেকটির ক্ষেত্রে প্রথমে নিশ্চিত করতে চেয়েছে মালিকানা কার। শান্তিনিকেতনের ক্ষেত্রে মালিকানা শান্তিনিকেতন ট্রাস্টেরই। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, শান্তিনিকেতনের সমীপে যখন এতকাল ধরে বহুতলগুলি উঠছিল, সেই জমিগুলির মালিকানা কার ছিল?
যেমন, শ্রীনিকেতনের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলি শুনেছিলাম স্থানীয় জমিদার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দান করেছিলেন। তাই যদি হয়, ওই অঞ্চলগুলিতে দ্রুত নগরায়ন হেতু বহুতলগুলি তৈরির অনুমতি কি শান্তিনিকেতন ট্রাস্টই দিয়েছিল? সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাই এই প্রশ্নের উত্তর জানেন।
প্রশ্ন আরো আছে। ইউনেস্কো যাকে ‘জীবন্ত ঐতিহ্য’ (লিভিং হেরিটেজ) হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছেন, তা কি শুধু ওখানকার ‘পাঠ ভবন’-এর কচি পড়ুয়াদের হলুদ বর্ণের আবরণে ভোরে প্রার্থনা দেখে? নাকি বসন্তোৎসবের নাচ দেখে? অথবা ভুবনডাঙার পৌষমেলার স্মৃতিতে। হ্যাঁ, স্মৃতিতেই।
রবীন্দ্র-স্মৃতি বিজড়িত বাড়িগুলি বাদে শান্তিনিকেতনে আর কীই বা রয়ে গেল যাকে জীবন্ত ঐতিহ্য বলা যায়? রামকিঙ্কর বেইজের স্থাপত্যকলাগুলি রয়ে গেছে? সেগুলিই কি এখন জীবন্ত ঐতিহ্য হয়ে ইউনেস্কো-র সদস্যদের প্রভাবিত করলো? কে জানে?
Comments