top of page

৭৩তম জন্মদিনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কি উপলব্ধি করছেন জনমানসে তাঁর ভাবমূর্তি ম্লান হচ্ছে?


আজ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জন্মদিন। ১৯৫০ সালে এই দিনে তিনি জন্মেছিলেন। সেই অর্থে বলা যেতে পারে যে, স্বাধীন ভারতে জন্মগ্রহণ করা এক ব্যক্তি এই প্রথম দেশের প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন।


নরেন্দ্র মোদীর যারা পূর্বসূরি ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ যোগ ছিল। ইংরেজ-বিরোধী বিভিন্ন আন্দোলনের সময়েই তাঁদের শৈশব কেটেছে। এবং পরবর্তীকালে, সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দিলে, প্রায় প্রত্যেকেই ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের ঐতিহ্যটি অন্তত স্মৃতিতে রেখেছিলেন।


নরেন্দ্র মোদী ক্ষেত্রে সেই স্মৃতি বা সেই পরম্পরার অংশীদার নন। এবং স্বাধীনোত্তর যুগে জাত প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তাঁর এক ভিন্ন মূল্যায়ন অবশ্যই প্রয়োজন। তবে সেই মূল্যায়নের উপাদানগুলি যথেষ্ট জটিল হয়ে যায়, প্রধানত যে মূল্যবোধগুলি তাঁর শৈশব থেকে যৌবনকে সিঞ্চিত করেছে।

কী সেই মূল্যবোধ?


দেশভাগের ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠরা যে স্বভাবতই সংখ্যালঘুদের উপর আধিপত্য বিস্তার করবে, আরএসএস-এর সেই সাংস্কৃতিক লক্ষ্যটিকে উগ্র এক রাজনীতিতে পরিণত করবার জন্যে যে শৃঙ্খলা, পক্ষপাতদুষ্ট মনোবৃত্তি এবং সময় ও সুযোগ পেলে সংখ্যাধিক্যের রোষটুকু নিয়ে সংখ্যালঘুর উপরে আক্রমণ – এই মূল্যবোধগুলি নিয়েই নরেন্দ্র মোদী সক্রিয়ভাবে ভারতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন।


শোনা যায়, ১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধী যখন জরুরি অবস্থা জারি করেন, তখন অনেক বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের মতো নরেন্দ্র মোদীও মেইন্টেনেন্স অফ ইন্টারন্যাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট (সংক্ষেপে 'মিসা')-য় বলীয়ান রাষ্ট্রশক্তির দ্বারা গ্রেফতার ও হাজতবাস এড়াতে আত্মগোপন করেন। অথচ, এই পর্বেই দেখা গেছে জয়প্রকাশ নারায়ন, মোরারজি দেশাই, অটলবিহারী বাজপেয়ী, লালকৃষ্ণ আদবানি প্রমুখ বিরোধী নেতৃস্থানীয়রা গ্রেফতার হচ্ছেন। ১৯৭৭ সালে ইন্দিরা গান্ধীকে পরাজিত করে ক্ষমতাসীন হন।


কিন্তু নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী আদর্শ মেনেছে বিনায়ক সাভারকরকে। গুরুস্থানীয় এই ‘বীর’ সাভারকর কিন্তু সেই শ্রেনীর স্বাধীনতা সংগ্রামী, যিনি কালা পানি পার আন্দামান জেলে জীবন কাটানো অসহ্য মনে হওয়ায় ব্রিটিশ শক্তির কাছে রীতিমতো চিঠি লিখে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং হলফনামা দিয়ে মুক্তি পান। ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর ইনিই সেই ব্যক্তি যিনি উগ্র সংখ্যাধিক্যবাদকেই ভারতের মূল রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক করে তোলেন।


১৯৯২ সালে বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদবানি যখন ‘রামরথ’-এ ভারত পরিক্রমায় বার হন, সেই বিধ্বংসী যাত্রার দায়িত্বভার নেওয়ার সুত্রে নরেন্দ্র মোদী সংবাদের শিরোনামে আসতে শুরু করেন। এবং এই পর্ব থেকেই স্পষ্ট হতে শুরু করে ভারতীয় জনতা পার্টি-র কেন্দ্রবিন্দুতে আলো করে বসে আছেন যে রত্নরা, তাঁরা মুলত রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের অতি-সক্রিয় সদস্যবৃন্দ।


কালক্রমে, বিজেপি গুজরাটে দু-বার নির্বাচনে জিতে নরেন্দ্র মোদীকেই মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত করে। ২০০২-তে গুজরাতে ধর্মদ্বেষের যে আগুন জ্বলে, তাতে এই মুখ্যমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ যোগ ছিল বলে অভিযোগ করা হয়, যদিও আইনত তা প্রমাণ করা যায়নি।


২০১৩ সালে বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে নরেন্দ্র মোদীকে যখন প্রচার করতে দেখা গেল সর্বত্র, প্রতিশ্রুতির বন্যায় সাধারণ মানুষ প্রভাবিত হন। কিন্ত বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদীর এই বিশাল প্রচারযন্ত্র চালু হওয়ার নেপথ্যে লোকপাল বিল নিয়ে আন্না হাজারের অনশন অবস্থানের একটা বড় ভূমিকা ছিল। বস্তুত, এই আন্দোলনটি চলাকালীনই একটা কথা স্পষ্ট হচ্ছিল।


ভারতবর্ষের মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষেরা তৎকালীন ইউপিএ সরকারের কাজকর্মে একেবারেই সন্তুষ্ট নয়। বস্তুত, সাধারণ মানুষের অসন্তোষ, আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলিকে পূরণ করবার আশ্বাস ছিল নরেন্দ্র মোদীর আশ্বাসে।


২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে সাধারণ মানুষ টের পান নরেন্দ্র মোদী সুশাসন, আতঙ্ক দূরীকরণ, ‘সব কা সাথ সব কা বিকাশ’ নিয়ে যতই গলা তুলুন না কেন, কাজের কাজ বিশেষ ঘটছে না। নোটবন্দির ফলে মধ্য ও ক্ষুদ্র শিল্পোদ্যোগগুলি ফলে যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হত এবং সাধারণ মানুষ এই নোট বদলানোর খেলায় যেভাবে নাকানিচোবানি খেয়েছেন, তাঁর জের সামলাতে না সামলাতে ২০১৯-এর সাধারণ নির্বাচন এসে যায়।


দ্বিতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রীত্বের আসন দখলে রাখতে নরেন্দ্র মোদীকে আমরা ‘বীর দেশপ্রেমী’ অবতারে দেখতে শুরু করি। পুলওয়ামায় সিআরপিএফ-র কনভয়ে আতঙ্কবাদীদের হামলার জবাবে যে বালাকোট পর্ব চলে, সেই উগ্র জাতীয়তাবাদের হুঙ্কারে অর্থনৈতিক মন্দা, সমাজের মেরুকরণ ইত্যাদি প্রাসঙ্গিক ইস্যুগুলি প্রায় ধামাচাপাই পড়ে গেল।


২০১৯-এ লোকসভায় আরেকটি কথা স্পষ্ট হয়। রাজনীতিবিদ হিসেবে নরেন্দ্র মোদী প্রমাণ করতে পেরেছিলেন যারা তাঁর বিপক্ষে দাঁড়িয়ে নির্বাচন লড়ছেন, তাঁদের বিভাজিত করে কীভাবে নিজের শক্তিবৃদ্ধি করা সম্ভব। রাজনৈতিক যোগ-বিয়োগে উনি তখন এতটা মনোযোগী ছিলেন, যে কোভিড অতিমারির ফলে লকডাউন ঘোষণা না করলে জনরোষ আটকানো হয়তো সম্ভব হতো না।


কিন্তু ২০২৪-এ নিজের আসন কায়েম রাখতে কী পথে হাঁটবেন মোদী? ১৮ সেপ্টেম্বরে ডাকা সংসদের বিশেষ পাঁচদিনের অধিবেশনে উনি বাহ্যত বলতে চাইছেন যে ভারতের স্বাধীনতা ৭৫-৭৬ বছর, যা ওনার ভাষায় প্রথমে ‘অমৃতকাল’ এবং পরে ‘কর্তব্যকাল’-এ রূপান্তরিত হয়, তার উদযাপন করা হবে সংসদে। ‘সংবিধান সভা’ পরিচালনার নেপথ্যে কি অন্য কৌশল কাজ করছে?


কারণ, অধিবেশনে আলোচ্য বিলের একটি হলো প্রধান নির্বাচন কমিশনার সহ অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ সংক্রান্ত। তাঁর ৭৩তম জন্মদিন পালনের মুহূর্তে নরেন্দ্র মোদী কি উপলব্ধি করেছেন যে ভারতের বৈচিত্রময় বহুত্ববাদীতার ইতিহাস পাল্টে দেওয়ার পাশাপাশি সংবিধান নির্ধারিত নির্বাচন প্রক্রিয়ার গোড়া ধরে টান না মারলে ইতিহাসেরই কালগর্ভে হারিয়ে যেতে হবে?

Comments


bottom of page