এমনটাই যে ঘটবে, তার পূর্বাভাষ ছিল। কিন্তু তা যে এমন ক্ষিপ্রতার সঙ্গে ব্যবহৃত হবে, সেই ধারণাটা বাস্তবেই ঘটলো আজ সোমবার, মহাত্মা গান্ধীর ১৫৪তম জন্মতিথিতে। ঘটলো সেইখানেই, যেখানে মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণ করতে ভারতের এবং বিদেশের মানুষেরা নিয়মিত আসেন।
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল সাংসদ, বিধায়ক, নেতা-নেত্রী সহ সমর্থকরা ধর্নায় বসেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের জব-কার্ড হোল্ডারদের সঙ্গে। রাজঘাটে মহাত্মা গান্ধীকে শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণ করে ওখানেই শুরু হয় ধর্না অবস্থান। যুক্তিও ছিল। মহাত্মা গান্ধীর নামাঙ্কিত গ্রামীণ পরিবারের ১০০ দিনের প্রকল্পে কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে বকেয়া টাকা উদ্ধার।
এই বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলবার সময়েই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাধা দিতে থাকে দিল্লীর পুলিশ সহ কেন্দ্রীয় সরকারের রিজার্ভ ফোর্স সহ অন্য সুরক্ষা কর্মীরা। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যখন বলছেন কেন রাজঘাটকেই তাঁর দল ধর্নার জন্যে বেছে নিয়েছে, প্রায় প্রতিটি মিনিটেই বাধা দেয় রাষ্ট্রীয় শক্তি। অভিষেককে বাধ্য হয়েই নিজের কথা বন্ধ করতে হয়। এবং তারপরেই কেন্দ্রীয় সরকারের পুলিশ লাঠি মেরে টেনে হিঁচড়ে তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থকদের রাজঘাট থেকে বার করে দেয়।
অহিংস আন্দোলনের পথিকৃৎ মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিনেই রাষ্ট্রশক্তি যে এমন বেপরোয়া হিংস্রতার আশ্রয় নিয়ে বিক্ষোভকারীদের অসম্মান করবে, তা ভাবা না গেলেও, আজ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এই আক্রমণ কেন? বিভিন্ন মহলেই এই নিয়ে উঠছে নানা প্রশ্ন।
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ধর্না শুরুর এক ঘণ্টা আগেই পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য বিজেপি-র সভাপতি সুকান্ত মজুমদার একটি সাংবাদিক বৈঠক করেন। সেই বৈঠকেই সুকান্তবাবু স্পষ্ট করে দেন অভিষেকের উপরে পুলিশ কেন চড়াও হবেন। রাজ্য বিজেপি-র সভাপতি বলছেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার তো নামেই। পিছন থেকে সরকার চালান অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।“
অর্থাৎ, পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি সংগঠন প্রধান শ্ত্রি হিসেবে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যাকেই নিশান করেছেন। এবং অমিত শাহ-র স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক, যার ইশারায় দিল্লী পুলিশ ওঠে বসে, জি হুজুরি করে, তা যে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে আটকাতে একেবারেই পিছ-পা হবেন না, তা বলাই বাহুল্য।
কিন্তু সুকান্তবাবু যে কৌশল নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সম্পাদককেই ‘পশ্চিমবঙ্গ সরকার’ হিসেবে মান্যতা দেন, তা কি একাধারে নৈরাশ্যের ইঙ্গিতও নয়? সিবিআই এবং ইডি দিয়ে নিরন্তর ব্যতিব্যস্ত করা সত্ত্বেও অভিষেক যে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ মানুষদের বঞ্চিতদের মনের কথাই কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন, এটা কি তাঁর অপরাধ?
তা যদি হয়, সেই ক্ষেত্রে বলতেই হবে যে বিজেপির-কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব, অর্থাৎ নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহ প্রকৃত অর্থেই বাংলার অভাবী মানুষদের কথাই ভাবেন না। এবং ভাবেন না এই কারণেই যে, ২০২১ সালে এত আবেদনের পরেও পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসকে সরিয়ে বিজেপি-র হাতে ক্ষমতা ভার তুলে দেয়নি।
বস্তুত, আজকের এই ধর্নার প্রয়োজনই হতো না যদি কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী গিরিরাজ সিং একটু উদ্যোগ নিতেন। পশ্চিমবঙ্গের বকেয়া অর্থরাশি বরাদ্দ করতে এত দেরি হচ্ছে কেন, এই সরল প্রশ্নের উত্তরে দুর্নীতির প্রসঙ্গ টানা হয়েছে। ভারপ্রাপ্ত আধিকারিকরা নিরীক্ষণেও এসেছিলেন। কিন্তু দুর্নীতির প্রমাণাদি না পেশ করেই অর্থরাশি বরাদ্দ করতে বিলম্ব কেন, তা নিয়ে উচ্চবাচ্য করেননি।
বিজেপি নিজেকে সংগঠিত, শৃঙ্খলাবদ্ধ দল হিসেবেই পরিচয় দেয়। ক্লিন্তু ২০১৬-র নোটবন্দির পর থেকেই দেখা যাচ্ছে অর্থমন্ত্রক থেকে শুরু করে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক বা স্বাস্থ্যমন্ত্রক – সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলির কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের কথা বলতে না দিয়ে অনবরত নরেন্দ্র মোদী বা অমিত শাহকেই দেখা যায়।
ঠিক তেমনই, কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী গিরিরাজ সিং নিজের বক্তব্যটুকুও রাক্তে পারছেন না। স্মৃতি ইরানী এবং ঐ শ্রেণীর নেতৃত্ব বা পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী নেতার কণ্ঠেই দুর্নীতির কথা শুরু থেকেই শোনা যাচ্ছে। এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মন্ত্রী গিরিরাজ সিং দীর্ঘকাল ধরেই তৃণমূলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা এড়িয়ে যাচ্ছেন।
আগামীকাল পশ্চিমবঙ্গের বকেয়া অর্থরাশি বিষয়ে গিরিরাজ সিংকে কি বক্তব্য রাখবার সুযোগ দেওয়া হবে? নাকি আক্রমণের লক্ষ্যবিন্দু অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বানিয়ে নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ, স্মৃতি ইরানী বা সুকান্ত মজুমদার বা শুভেন্দু অধিকারীর বিজেপি দেশের সংবিধান-প্রদত্ত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোটাকেই ভাঙবার দিকে আর এক পা এগিয়ে যাবে?
Comments