প্রবাদটা ছিল,’অতি লোভে তাঁতি নষ্ট’। শহরে তাঁতি নেই, আছে শুধু নেট ব্যবহারকারী। আর যারা নেট ব্যবহার করে, তাঁদের লোভ স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে একটু বেশিই।
অন্তত জালিয়াতরা তেমনটাই ভাবে। সেই ভাবনায় ভুল একেবারেই নেই।
বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল, ঝাড়খণ্ডের মধুপুর জংশনের আগের স্টেশন জামতারা, রাতারাতি প্রসিদ্ধ হয়ে যায় শুধুমাত্র এই সাইবার জালিয়াতদের জন্যেই। একটি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম এদের সাইবার জালিয়াতি নিয়ে একটি ধারাবাহিকের দুটি পর্ব স্ট্রিম করে। এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্মটির হিসেব থেকেই জানা যায়, ধারাবাহিকের দীর্ঘ দুটি পর্ব, বহু ভারতের মানুষ দেখেছেন।
অর্থাৎ, সাইবার জালিয়াতি যে আমেরিকা, মিডল-ইস্ট, দিল্লী, মুম্বাইয়ের জটিল নাগরিক জীবন থেকে ভেসে এসে হঠাৎ করে ভারতের পূর্বাঞ্চলের আকাশ থেকে টুপ করে কলকাতা এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে, তা কিন্তু নয়।
কম্পিউটার অ্যান্টি-ভাইরাসের এক অন্যতম বিক্রেতা কুইক হিল-এর পরপর দুই বছরের দেওয়া হিসেব অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে যে বর্তমানে যে শহরে সবচেয়ে বেশি সাইবার প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে, তাঁর নাম কলকাতা। তাদের তালিকা অনুযায়ী, এই ধরণের জালিয়াতির ঘটনাস্থল পশ্চিমবঙ্গের স্থান সব চেয়ে উপরে।
কলকাতাবাসীর বুদ্ধি বা বিবেক বোধের প্রতি এই পরিসংখ্যান ইতিবাচক বিশেষ কিছুই বলছে না। বরং সমালোচনা করছে, সতর্ক করছে যে, সংযত হন। বিশেষ করে নগরজীবনে অভ্যস্ত বাঙালিদের জন্যে এই সতর্কবার্তার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি প্রযোজ্য।
কারণ, হুজুগে জাত হিসেবে বাঙালি যথেষ্ট কুখ্যাত। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। কোভিড অতিমারিতে যখন লকডাউন চলছে, তখন অনলাইন ডেলিভারির চাহিদা বহুলাংশে বেড়ে যায়। বিশেষ করে অনলাইন ফুড ডেলিভারি-র রমরমা শুরু হয় লকডাউন থেকেই।
সেই লকডাউন পর্ব পিছনে রেখে চলে এসেছি এক বছর। অথচ, অনলাইন ফুড ডেলিভারি এখনও বঙ্গজীবনের অঙ্গ। হয়তো ভারতের অন্যত্র একই ভাবে অ্যাপ ব্যবহার করে খাবারের অর্ডার দেওয়া লাগাতার চলছে। কিন্তু কলকাতা এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে রাস্তায়-ঘাটে যে পরিমাণে ইউনিফর্ম পরা ডেলিভারি বয়, গার্লদের বাইক, স্কুটার, এমনকি সাইকেলেও ব্যাগ বোঝাই করে বিভিন্ন এলাকায় খাবার সরবরাহের জন্যে রাত দিন যাতায়াত করতে দেখা যাচ্ছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে বিক্রেতারা বুঝে গেছেন খাওয়ার হুজুগ হলেই বাঙালি অ্যাপে খাবার বুক করবে।
এবার আসা যাক লোভের কথায়। কোনো সাইবার প্রতারকের ক্ষমতা নেই যে আপনার ‘অগোচরে’ আপনার অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা হাতিয়ে নেবে। গ্রাহকের অনুমতি না থাকলে কারোর ক্ষমতা নেই যে সে আপনাকে লুট করবে। এমনকি, আপনার ব্যাঙ্ক কতৃপক্ষও , আপনার অনুমতি না নিয়ে আপনার অ্যাকাউণ্টের থেকে টাকা কেটে নিতে পারেন না।
তাহলে জালিয়াত্রা টাকাটা লুট করছে কীভাবে? আপনাকে ফোন করছে। কুইক হিল-এর সমীক্ষাটি বলছে, পশ্চিমবঙ্গে ২০২২ সালে সাইবার হানার ঘটনা ঘটেছে প্রায় সাড়ে চার কোটি বার। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ কলকাতার। আপনার হদিশ কীভাবে জানতে পাচ্ছে জালিয়াতরা?
অচেনা নামবার থেকে ফোন এলো। আপনি ফোনটি রিসিভ ক্ল্রলেন। এক ভদ্র পুরুষ বা মহিলা আপনাকে ব্যাঙ্ক বা অন্য স্নগস্থার ক্রেডিট কার্ড নিয়ে, অথবা বীমা সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার কাছে প্রস্তাব রাখছে। আপনি তাতে প্রলুব্ধ না হয়ে ফোন কেটে দিলেন। গল্প শেষ।
কিন্তু যদি আপনি মনে করেন যে ফোনের অন্যপ্রান্তের জালিয়াতটি আপনার আর্থিক স্বচ্ছলতার উন্নতি করবার জন্যেই ফোনটি করেছে, তো আপনি পড়লেন তার ফাঁদে। জালিয়াত আপনার মুখ থেকে অথবাা মোবাইলের মাধ্যমে এমন তথ্য বার করে নেনে, যা আপনার অ্যাকাউন্ট সংক্রান্ত। বলা যেতে পারে জালিয়াতের হাতে আপনি আপনার অ্যাকাউন্টের চাবিটি তুলে দিলেন। এবং আপনার টাকা লুঠ করবার ব্যবস্থা আপনিই জালিয়াতকে করে দিলেন।
নিঃসন্দেহে, প্রতারণা একটি বড় ধরণের অপরাধ। পুলিশ এই অপরাধের বিরুদ্ধে যথেষ্ট তৎপর। পুলিশের সাইবার-সিকিউড়িটি সেল রাত-দিন অবিরত এই জালিয়াতদের ঠেকাতে ব্যস্ত। ২০২১ সালে এই জালিয়াতদের সাম্লাতেই তৈরি হয়েছে সাইবার এমার্জেন্সি রেসপন্স টিম। কিন্তু মুশকিলটা একটাই। কারণ, জালিয়াতেরা পুলিশের থেকে অন্তত দুটি পা এগিয়ে আছে। প্রথম যে পা-টি এগিয়ে আছে, তা আপনার জন্যেই, স্বাভাবিক প্রবৃত্তিবশে আপনিই জালিয়াতকে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। এটা অজ্ঞতা বলি, বা আপনার লোভ – তা আপনিই বলবেন।
জালিয়াতরা সাপের মতো। ছিদ্র খোঁজে। সেই ছিদ্র আপনিই তাদের জন্যে খুঁড়ে দিচ্ছেন। এবং আপনার মতো এই দেশে, এই রাজ্যে, অনেকেই।
Comments