পুলিশের চাকরির ইন্টারভিউয়ের আগেই কিছু পরীক্ষার্থীর হোয়াটসঅ্যাপে পৌঁছেছিল গোপন খবর। কারা ইন্টারভিউ বোর্ডে থাকবেন, কারা প্রশ্ন করবেন, সেই তথ্য জানতে পেরেছিলেন কিছু পরীক্ষার্থী। পরে মেধা তালিকা প্রকাশের পরও দেখা যায় বেশ কিছু অনিয়ম রয়েছে। সেই অনিয়মের অভিযোগ এনেই কলকাতা হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন পুলিশ কনস্টেবল পদের কিছু চাকরিপ্রার্থী। চ্যালেঞ্জ করেছিলেন ৮৪১৯ জন পুলিশ কনস্টেবলের নিয়োগকে। বুধবার সেই মামলার রায় ঘোষণা করল হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ। রাজ্যের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগকে মান্যতা না দিলেও আদালতের রায়ে কয়েকশো পুলিশ কনস্টেবলের চাকরি যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
মামলাকারীদের দাবি ছিল, যেহেতু পুলিশে নিয়োগের চাকরিতে দুর্নীতি হয়েছে, তাই গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়াটাই খারিজ করতে হবে। পাশাপাশি, সংরক্ষিত চাকরিপ্রার্থীদের জন্য আলাদা তালিকাও প্রকাশ করতে হবে। মামলাকারী সম্পদ মন্ডল-সহ কয়েকশো চাকরিপ্রার্থী ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রুজু করেন এই মামলা। বুধবার তার রায় ঘোষণা করে হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম এবং বিচারপতি হিরণ্ময় ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চ।
২০১৯ সালে শুরু হওয়া এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় মোট দু’টি মেধা তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল। এর মধ্যে প্রথম মেধা তালিকাটি প্রকাশ করা হয় ২০২১ সালের ২৬ মার্চ। যা নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন মামলাকারীরা। পুলিশ রিক্রুটমেন্ট বোর্ডের বিরুদ্ধে তারা মামলাও করে ওয়েস্ট বেঙ্গল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইবুনালে। ট্রাইবুনাল পুলিশ কনস্টেবলদের নিয়োগ সংক্রান্ত ত্রুটি শুধরনোর নির্দেশ দিয়েছিল ওয়েস্ট বেঙ্গল পুলিশ রিক্রুটমেন্ট বোর্ডকে। এর পরেই প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় মেধা তালিকা। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সংরক্ষণের নিয়ম মেনে সেই তালিকা প্রকাশ করা হয়। নতুন করে চাকরিও পান অনেকে। কিন্তু বুধবার কলকাতা হাই কাের্ট এই দ্বিতীয় তালিকাটি খারিজ করে প্রথম তালিকাটিকেই মান্যতা দিয়েছে। একই সঙ্গে এ ব্যাপারে স্যাট বা স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইবুনাল যে নির্দেশ দিয়েছিল, তা-ও খারিজ করেছে।
মামলাকারীদের তরফে আদালতে সওয়াল করেন আইনজীবী অনিন্দ্য লাহিড়ী, ফিরদৌস শামিম এবং দিব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়। হাই কোর্টের বেঞ্চ তাঁদের বলে, ‘‘পুলিশ রিক্রুটমেন্ট বোর্ডের প্রকাশিত প্রথম মেধাতালিকাই বহাল থাকবে। ২০২১ সালের তালিকা বা প্যানেল পুনরুদ্ধার করতে হবে। ওই প্যানেল অনুযায়ীই নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে।’’ আর এতেই দ্বিতীয় তালিকায় চাকরি পাওয়া কনস্টেবলদের চাকরি যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। আপাতত কয়েকশো কনস্টেবলের চাকরি বাতিলের সম্ভাবনা রয়েছে বলে অনুমান। তবে আদালত নির্দেশ দিয়েছে, বকেয়া শূন্যপদ থেকে মেধারভিত্তিতে নতুন করে নিয়োগ করা যেতে পারে।
আগে যা হয়েছিল
২০১৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি পুলিশ কনস্টেবলের ৮৪১৯ পদে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি করে ওয়েস্ট বেঙ্গল পুলিশ রিক্রুটমেন্ট বোর্ড।
পাঁচটি ধাপে নিয়োগের প্রক্রিয়া করা হয়:
১) ১০০ নম্বরের প্রিলিমিনারি লিখিত পরীক্ষা
২) শারীরিক মাপজোকের পরীক্ষা (উচ্চতা এবং ওজন দেখা হয়)।
৩) শারীরিক দক্ষতার পরীক্ষা (সাড়ে ৬ মিনিটে ১৬০০ মিটার দৌড়তে হবে)
৪) ৮৫ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা।
৫) ১৫ নম্বরের ইন্টারভিউ।
২০১৯ সালের ৪ অগস্ট প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেওয়া হয়। ২০২০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ফাইনাল লিখিত পরীক্ষা হয়। কিন্তু ওই পরীক্ষার ফল প্রকাশ করেনি বোর্ড। ফলে কে, কত নম্বর পেয়েছেন জানা যায়নি।
ফল প্রকাশের পরিবর্তে বোর্ড ওয়েবসাইটে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ইন্টারভিউয়ের জন্য রোল নম্বর ব্যবহার করে অ্যাডমিট কার্ড সংগ্রহ করতে বলে। বলা হয়, যে সব প্রার্থীর রোল নম্বর দেওয়ার পরে অ্যাডমিট কার্ড আসবে না, তাঁদের অনুত্তীর্ণ বলে ধরা হবে।
সেই মতো মামলাকারীরা ইন্টারভিউয়ের জন্য অ্যাডমিট কার্ড সংগ্রহ করেন। ফলে স্বাভাবিক ভাবে নিয়োগপ্রক্রিয়ার পরবর্তী ধাপে তাঁরা সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছেন বলে মনে করেন।
২০২০ সালের ২২ জুন বোর্ড বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানায়, ওই বছর ১৩ জুলাই থেকে এলাকাভিত্তিক নির্দিষ্ট জায়গায় ইন্টারভিউ নেওয়া হবে। পরে ওই বছর লকডাউন ঘোষণা হওয়ায় ইন্টারভিউ পিছিয়ে ১২ অগস্ট থেকে নেওয়ার কথা বলা হয়। ইন্টারভিউতে ডাকা হয় ১২,৭৮৬ জনকে।
কিন্তু অভিযোগ, ইন্টারভিউ নেওয়ার ক’দিন আগে অনেক প্রার্থীর কাছে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ যায়। সেখানে ইন্টারভিউ বোর্ডে কারা রয়েছেন তাঁদের নাম এবং পরিচয় জানানো হয়। ফলে ইন্টারভিউ বোর্ডের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বেআইনি ভাবে নিয়োগের সম্ভাবনা তৈরি হয়।
মামলাকারীদের বক্তব্য, ইন্টারভিউ বোর্ডের সদস্যদের নাম জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়মবিরুদ্ধ। এর ফলে নিয়োগে দুর্নীতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এই ধরনের সিদ্ধান্ত সমগ্র নিয়োগপ্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। ইন্টারভিউ হওয়ার আগে এ নিয়ে মামলাকারীরা প্রতিবাদ জানাতে সাহস পাননি। তাঁরা ইন্টারভিউতে অংশগ্রহণ করেন।
২০২০ সালের ১৫ অক্টোবর সল্টলেকের অফিসে ৮৪১৯ জনের মেধাতালিকা প্রকাশ করা হয়। দেখা যায়, ওই তালিকায় স্থান পাননি মামলাকারীরা। এমনকি, প্রার্থীদের লিখিত এবং ইন্টারভিউয়ে প্রাপ্ত নম্বরেরও উল্লেখ ছিল না মেধা তালিকায়। সংরক্ষিত প্রার্থীদের জন্য কোনও তালিকা প্রকাশ করা হয়নি। অর্থাৎ সংরক্ষণ নীতিও মানা হয়নি মেধা তালিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে।
এর পরে বোর্ডের ওয়েবসাইটে গিয়ে চাকরিপ্রার্থীরা নিজেদের নম্বর ছাড়া আর কারও নম্বর দেখতে পাননি। ফলে কেউ নিজের নম্বর অন্যদের সঙ্গে তুলনা করতে পারেননি। যাঁদের নিয়োগ করা হয়েছে তাঁদের নম্বর সম্পর্কেও জানা যায়নি ওয়েবসাইট থেকে। এ ছা়ড়াও চাকরিপ্রার্থীদের প্রাপ্ত মোট নম্বর দেখা গেলেও বিষয়ভিত্তিক নম্বর বিভাজন ছিল না ওয়েবসাইটে। মামলাকারীরা তাই অভিযোগ করেন, সরকারি চাকরির নিয়োগে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে।
মামলাকারীরা এ-ও বলেন যে, কনস্টেবলের জন্য নির্ধারিত ন্যূনতম ১৬৭ সেমির কম উচ্চতা রয়েছে, এমন অনেককেই চাকরি দেওয়া হয়েছে। নিয়োগে স্বজনপোষণ হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তাঁরা।
২০২১ সালের ১০ মার্চ নিয়োগে অনিয়মের এই অভিযোগ এনে ওয়েস্ট বেঙ্গল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইবুনালে মামলা করা হয়েছিল। ২০২২ সালের ২৮ জানুয়ারি ওই মামলাটি খতিয়ে দেখার পর বোর্ডকে ট্রাইবুনাল নির্দেশ দেয়, চার সপ্তাহের মধ্যে নতুন করে প্যানেল প্রকাশ করে নিয়োগের সুপারিশ দিতে হবে। ট্রাইবুনাল তাদের রায়ে বলেছিল, আইন মেনে সংরক্ষিত প্রার্থীদের তালিকাও আলাদা করে প্রকাশ করতে হবে। যদিও ত্রুটিপূর্ণ নিয়োগের অভিযোগে সমগ্র নিয়োগপ্রক্রিয়া খারিজের আর্জিতে সাড়া দেয়নি ট্রাইবুনাল।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতেই ট্রাইবুনালের ওই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে হাই কোর্টে মামলা করেছিলেন সম্পদ মন্ডল-সহ কয়েকশো চাকরিপ্রার্থী। উচ্চ আদালতে তাঁরা আবেদনে জানান, ১) ওই নিয়োগের সমগ্র প্রক্রিয়া খারিজ এবং বাতিল করা হোক। ২) চূড়ান্ত পরীক্ষার ওএমআর শিট এবং উত্তরপত্র মামলাকারীদের দেওয়া হোক।
২০১৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি পুলিশ কনস্টেবলের ৮৪১৯ পদে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি করে ওয়েস্ট বেঙ্গল পুলিশ রিক্রুটমেন্ট বোর্ড।
Comments