top of page

আরএসএস কি নিজের পুরুষ-প্রধান ছাপটিকেই এখন মুছে ফেলতে চাইছে?


গত দু-দিন ধরে যাদের মুখে অনবরত মহিলা সশক্তিকরণের বুলি শোনা যাচ্ছে, তাঁরাই কিন্তু এতদিন মহিলাদের সন্তান-উৎপাদন যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই কিছুই ভাবেননি। মহিলা সংরক্ষণ বিলটি সংসদের বিশেষ অধিবেশনে পেশ হওয়ার পর থেকেই এই আত্মম্ভরি পুরুষরাই ঘোষণা করছেন মহিলাদের হাতে এবার নেতৃত্ব তুলে দিতে হবে!


সাধারণ নির্বাচন আসন্ন, রাজ্যে রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনে হারের পর হার। প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া প্রতিশ্রুতিতে মানুষদের আস্থা নেই। ২০১৯-এর বালাকোট হামলার মতো আরেকটা হামলার মাধ্যমে উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রচার দমদার হবে কি না, তা নিয়ে বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতাদেরই সন্দেহ রয়েছে।


নির্বাচনী অঙ্ক নিয়ে সারা দিনটা কাটানোর অবকাশই পান না, এমন মানুষরাও ইদানিং লক্ষ্য করেছেন যে বিধানসভার ভোটগুলিতে মহিলা ভোটারদের সংখ্যা যথেষ্ট বেড়ে গেছে। অর্থাৎ, যে দেশটাতে অধিকাংশ পরিবারের কর্তা এতদিন ধরে যাদের নির্দেশ দিয়ে এসেছেন যে কাকে ভোট দিতে হবে, সেই মহিলারাই এখন বাইরে ভোটদান কক্ষে এসে নিজের বোধবুদ্ধি অনুযায়ী ইলেকট্রনিক ব্যালট বাক্সের বোতাম স্পর্শ করছেন।


তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো যে,গৃহবধূদের একটি অদেখা সমন্বয় ঘটেছে রাজ্যগুলি জুড়ে। কেউ কাউকে হয়তো চেনেন না, অথবা আলাদা করে আলোচনাও করবার পরিসর বা অবকাশ নেই তাঁদের। তবুও বাবা, ভাই, ছেলে এবং স্বামীদের মতামত নির্বিশেষে ভোটের মাধ্যমে নিজেদের সিদ্ধান্ত প্রকাশে আর তাঁদের ভয় বা দ্বিধা নেই। অর্থাৎ, তাঁদের আলাদা কোনো ঐক্যমঞ্চ নেই। অথচ ভোটদানে তাঁরা প্রমাণ করছেন যে তাঁদের নিজস্ব স্বর আছে।


বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে ইউরোপে এবং আমেরিকায় সাফ্রাগেট নামের একটি মহিলা সংগঠন অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ‘সুসভ্য’ ইউরোপ বা আমেরিকা যে মহিলাদের ভোটদান দেওয়ার সুযোগটিই দেয়নি, তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ছিল সাফ্রাগেট। তৎকালীন যুগেআলোকপ্রাপ্ত মহিলা মাত্রেই নিজেকে সাফ্রাগেট হিসেবে গর্বের সঙ্গে অভিহিত হতে চাইতেন। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় মহিলারাও যে অত্যাবস্কীয়, তাঁদের যে ভোটদানের অধিকার দিতে হবে, তা নিয়ে সোচ্চার হতে কেউ তাঁদের বাধা দিতে পারেনি।


স্বাধীন ভারতবর্ষের সংবিধান রচয়িতা বাবাসাহেব আম্বেদকর এই দেশের ভোটদান প্রক্রিয়ায় অন্তত লিঙ্গভেদের অবকাশ রাখেননি। তাই ভারতে সাফ্রাগেট আন্দোলন প্রাসঙ্গিক হয়নি। কিন্তু ভারতের পুরুষদের যে প্রাতিষ্ঠানিক দাপট, তা মহিলাদের প্রতিরোধ করতে হয়েছে পদে পদে। কোভিড লকডাউন অবধি অন্তত ভারতের সামজিক পরিচিতিতে পুরুষতন্ত্র রাজ করেছে।


লকডাউনের ঠিক আগে ভারত দেখেছে সংখ্যালঘু পর্দানশিন মহিলারাও সিএএ এবং এনআরসি লাগু হওয়ার বিরুদ্ধে খোলা আকাশের নিচে দিনের পর দিন অবস্থান বিক্ষোভে বসে ছিলেন। সেই যন্ত্রণা এবং ধৈর্য কিন্তু সংখ্যাগুরু শ্রেণীর মহিলাদের বিবেকেও আঁচড় কেটেছে। হয়তো ইলেক্ট্রনিক সংবাদ মাধ্যম অন্তত এই অভূতপূর্ব সময়ে একটি ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পেরেছিলেন। ঘরের বাইরে যা কিছু, তা আর দূর বা অচেনা ছিল না মহিলাদের কাছে।


লকডাউনের দীর্ঘ এবং যন্ত্রণাদায়ক দিনগুলি শেষ হওয়ার আগেই কোভিড অতিমারি চলাকালীণ পশ্চিমবঙ্গে যে বিধানসভা নির্বাচন হয়, তাতে বিজেপি হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে যায় যে মহিলাদেরকে টুপিটাপা দিয়ে যা কিছু বোঝালেই তাঁরা আর বুঝবেন না। সেইদিক থেকে বলা যেতে পারে, পশ্চিমবঙ্গ থেকেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি-র একচ্ছত্র আধিপথ্যের ভাঙন শুরু।

আর তারপর থেকে ভারতবর্ষের অধিকাংশ রাজ্যে যেখানেই নির্বাচন হয়েছে, মহিলারা বিজেপি-কে একটি কঠিন বার্তা দিয়েছে। দেশের ‘সর্বাধিক সংখ্যক সংখ্যালঘু (বিগেস্ট মাইনরিটি) হয়ে তাঁরা আর বাঁচতে রাজি নয়।


আসন্ন ২০২৪-এ বিজেপি এই বার্তাটি গ্রহণ করেছে। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো, বিজেপি-র মগজ অর্থাৎ নাগপুরের আরএসএস টের পেয়েছে এবার খোলসটা বদলাতেই হবে। ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রধান মোহন ভাগবত তাৎপর্যপূর্ণভাবে, ২০১৭ সালের একটি সমীক্ষার উল্লেখ করেন। সেই সমীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে, “ভারতে এমন কোনো কাজ নেই যা পুরুষরা করতে পারেন, অথচ মহিলারা পারেন না।“


বিজয়া দশমীর সেই ভাষণে মোহন ভাগবত বলেন, “যদি সমাজকে সংগঠিত হতে হয়, তাহলে তার ৫০ শতাংশই ঘটবে মাতৃশক্তির দ্বারা। সেই শক্তিকে অবহেলা করা যাবে না। আমরা সেই শক্তিকে হয় প্রার্থনাকক্ষে তালা দিয়ে রাখি, নয়তো দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বলি, আর তা না হলে বাড়ির ভিতরে দরজায় শিকল তুলে বন্ধ করে রাখি। এই মানসিকতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। মহিলাদেরকে আরো সক্রিয় করে তুলতে হবে সমান অধিকার প্রদান করে। ঘরেতে এবং ঘরের বাইরে জনবৃত্তে। তাঁদেরকে সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা দিতে হবে।”


এর পরে এই বছরে মার্চ মাসে হরিয়ানায় অখিল ভারতীয় প্রতিনিধি সভায় সংঘের সাধারণ সম্পাদক দত্তাত্রেয় হোসাবলে নির্দেশ দেন যে সংঘের বিভিন্ন অনুষ্ঠান, যেমন কুটুম্ব প্রবোধন, সেবা বিভাগ, প্রচার বিভাগে মহিলাদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। নাহলে সাফল্য আসবে না।


গত আগস্ট মাসের দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ে মহিলা সশক্তিকরণ নিয়ে একটি আলোচনাসভায় আরএসএস-এর যুগ্ম সম্পাদক কৃষ্ণ গোপাল সংখ্যাধিক্যের রাজনীতিকে মহিলা-কেন্দ্রিক বিষয়ে সরাসরি নিয়ে আসেন। তিনি বলেন, “জনজীবনে মহিলাদের অংশগ্রহণের অভাবটিকে ভারতীয় সংস্কৃতি বলা যায় না। ইসলামএর আক্রমণেই তা এই দেশে আমদানি হয়েছে।“


সংসদের বিশেষ অধিবেশনটি শুরু হওয়ার আগে আরএসএস-এর একটি দু-দিনের সমন্বয় বৈঠক হয়। তাতে সংঘের সঙ্গে জড়িত ৩৬টি সংগঠনের সদস্যরা উপস্থিত হন। তাঁদের উদ্দেশ্যে সংঘের আরেক যুগ্ম সম্পাদক মনমোহন বৈদ্য ঘোষণা করেন, “আরএসএস-অনুপ্রানিত সংগঠনগুলিকে বিশেষভাবে চেষ্টা করতে হবে যাতে সর্বক্ষেত্রে অধিক সংখ্যায় মহিলারা অংশ নিতে পারে এবং তাঁদের যেন নেতৃত্বদানের সুযোগ দেওয়া হয়।”


আরএসএস যে পুরুষপ্রধান, তার সবচেয়ে বড় পরিচয়, সংগঠনটি মহিলাদের ‘দিতে চায়’। মহিলারা কি এখনও দুর্বল যে ‘দেওয়া হচ্ছে বলেই নেবেন’? আর যদিও বা তাঁরা নেন, সেই ‘দান’-এর মধ্যে দিয়ে কি আরএসএস মুছে দিতে পারবে তার পুরুষ-প্রধান পরিচিতি?

Comments


bottom of page