লিখছেন সাংবাদিক সুমিত
(এই লেখা লেখকের একান্তই ব্যক্তিগত মতামত)
সকাল থেকে ফেসবুকে ভাসছে ছবিটা। মুসলমান শিশুকে প্রধানশিক্ষিকা চড় মারতে বলছেন। জড়তা নিয়েই একেএকে চড় মেরে যায় হিন্দু শিশুরা। চড়ের আঘাত কম হলে বকে দেন শিক্ষিকা স্বয়ং। মোবাইল ক্যামেরা ধরা পুরুষকণ্ঠ হাসতে থাকে।
বিদ্বেষ-ব্যাটন প্রজন্ম বদলায়। ওই যে জড়তা, ওই যে জাতপাত বর্ণহীন শিশুর দল, তাকে যুদ্ধ -রক্ত-ঘৃণা শেখানোর দায় নিয়েছে মোদির ভারত। শিক্ষিকা স্বয়ং শিক্ষা দিলে, এ শিক্ষা শিকড়ে পৌঁছবে। ভিডিও করে ছড়িয়ে দিলে গোলওয়ালকারের স্বপ্নের হিন্দুভূমিতে দূরদূরান্তের, প্রান্তের বাবা-মা, ঘর-বিরাদরি, মহল্লা-ইলাকেবালা বুঝে নেবে, 'এসব না করলে পিছিয়ে পরতে হয়'।
ভারতীয় বিজ্ঞানীদের আকাশজয়ের আনন্দ-রেশ থাকবে বহুকাল। অনেক কারণের মধ্যে একটি কারণ, লাখো কুসংস্কারের মধ্যেও শিশুপাঠ্য থেকে স্কুলে বিজ্ঞান পড়ানোর নীতি। রাজ্য-রাজ্যে ক্ষমতা পাওয়ার পর সে রীতি বদলে দিচ্ছে বিজেপি। ইতিহাস হয়ে উঠছে কাল্পনিক। বিজ্ঞানের পাতায় যুক্ত হচ্ছে আদি ভৌতিক বিশ্বাস।
খেয়াল করে দেখলে দেখা যাবে, ইসরোর বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের খুবই নগন্য অংশ মোদিজমানার স্নাতক বা স্নাতকোত্তর। শিক্ষা ও মনস্কতায় বিজেপির শিক্ষানীতির প্রসাদ-বঞ্চিত বিজ্ঞানীর দল যে বিশ্বাস ও সাধনায় অসাধ্য সাধন করলেন, তার সঙ্গে হিন্দুত্ব-বেদ-বেদান্তের কোনও সম্পর্ক নেই। আধুনিক ভারতীয় বিজ্ঞানের মনীষীরা যে যাত্রা শুরু করেছিলেন, তাতে সত্যেন বোস আর জাহাঙ্গির ভাবাদের নিমগ্ন সহাবস্হান ছিল। সেই সহাবস্হান আর সাধনার পরম্পরায় ইসরোর নানান কক্ষে মনোনিবেশ যারা করলেন, কারা তারা? হিন্দু? মুসলমান? নাকি বিজ্ঞানী? নাস্তিক? নাকি বিজ্ঞানমনস্ক সেই সব সাধকের দল, যারা ইতিহাস ব্যাপী খুঁজে যাচ্ছেন অস্তিত্ব।
ইসরোর বাইরের পৃথিবীটাই আমার আপনার। নানান শ্রেণির, ধর্মমতের, জাতপাতের, বর্ণবৈষম্যের, আর্থিকবৈষম্যের, আগ্রাসনের, প্রকট বা প্রচ্ছন্ন মৌলবাদের, পার্লামেন্ট টু পঞ্চায়েতের।
হাজারো রক্তাক্ত মুখ, গণপিটুনিতে লাশ হতে চলা আফরাজুল, পহেল খান, জাহিদ খান বা আসগার আনসারিদের পিটিয়ে মারার সময়ের ভিডিও আমরা দেখেছি। দেখেছি রামনবমী, হনুমান জয়ন্তীর জোশ নিয়ে মসজিদে মসজিদে কারা উরিয়ে দিচ্ছেন ভাগোয়া ঝান্ডা। দেখেছি গোমাতারর নামে শয়েশয়ে কুসংস্কারী সরলবিশ্বাসীর দল গণপিটুনিতে রক্তাক্ত করছে দাদরি, সাহারানপুর, ফরিদাবাদ, নাগপুর, আলাওয়ার, নগাঁও, মিরাট বা দিনাজপুরের মাটি। অজস্র ক্যামেরায় লাইভ হচ্ছে। ছড়িয়ে পরতে পরতে আসমুদ্র-হিমাচল টপকে যাচ্ছে বিদ্বেষের বিষ-ফেনা। যে ফেনায় আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আমাদের প্রতিবাদ ধীরেধীরে হয়েছে ম্লান। কোমল হয়েছে স্বর। চারপাশের ফেটে পড়া স্লোগান ও অভ্যাসও থমকেছে, চিৎকার বদলেছে বিড়বিড়নিতে।
মজফ্ফরপুরের ভিডিওতে মুসলিম শিশুকে চড়ের দৃশ্যে আমাদের রাগ হল বটে, বিরক্ত হলাম অনেকেই, 'আবার একটা!' - বলে স্ক্রল করলাম বহুজন। চিৎকার গেল কই। হ্যাঁ, চিৎকারের ঠিকানা বদলেছে আট-নয় বছর হল। সকাল সন্ধ্যার টেলিভিশন নিউজে চিৎকার থাকে ঠাসা। থাকে হিন্দু, থাকে মুসলমান, থাকে নানান কিসিমের প্রাক-দাঙ্গা বা সেমি-দাঙ্গার রসদ। চিৎকারে কাঁপে স্টুডিও, ঘটনার স্হান-কাল-পাত্র বদলায়, চিৎকার ও নিরবতার বর্তমান সহাবস্হান জোরালো হয়। আলতো হেসে পাশ ফিরে শোয় গোয়ালকার বা গডসের ভারত।
খবরটা চাঁদজয়ের ছিল। নানা রাজ্যের, নানা জেলার, ব্লকের ভারতের উচ্ছাসে ছিল সৃষ্টির নিয়ে কৌতুহল ও অস্তিত্ব জানার আনন্দ। মুসলমান শিশুকে মারার দৃশ্যের আগে চন্দ্রযানের চাঁদ ছোয়া যে ভারত দেখলো, কেন অভ্যাস ভাঙেনা সেই বিচিত্রভূমি? মিডিয়া, মনন, ফেসবুক, পাড়ার রোয়াকে যে প্রচ্ছন্ন বিভাজনে অভ্যস্ত হয়েছি আমরা, তাকে দূরে ফেলা সহজ নাকি?
বিজ্ঞানীদের খবর আসা শুরু হল। বিশ্ববিদ্যালয়, ফেলে আসা কলেজ, কৈশোরের গ্রাম-স্কুল খু্ঁজে বের করলো এলাকার বিজ্ঞানী, কলেজের সিনিয়ার, স্কুলের জুনিয়ার বা ক্যাম্পাসের সেরাকে। তথ্যের প্রবাহ থেকে 'সজাগ মিডিয়া' ছড়িয়ে দিচ্ছিল বিজ্ঞানসাধকদের নাম। তবু খটকা লাগল, পরম্পরা আর প্রজন্মান্তর হয়ে সে খোঁজের যাপন-বিভাজন স্পষ্ট। মুসলমান সাংবাদিক বা পরিচিত খুঁজে দিলেন মুসলমান বিজ্ঞানীর নাম। হিন্দু পরিচিত ও সাংবাদিকরা পেলেন হিন্দু নাম। দিন কয়েক এটাই চলছে। এটাই চলল। দেখা গেল, লোকাল সংবাদদাতারা খবর দিচ্ছেন। কর্পোরেট হাউসে গ্রাফিক্স আর পরিবেশনায় রং লাগছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় উৎফুল্ল জনতার লাইক-কমেন্ট-শেয়ারে বাড়ছে ভিউর সংখ্যা। টেলিভিশন চ্যানেলের ফোন কল বা ইন্টারভিউতে যে বিজ্ঞানীদের দেখা গেল, - তারাও হিন্দু।
না, বন্ধু, এ তো সহবাস নয়! এতো আমাদেরই বিভাজনের প্রবাহ, এই তো আরএসএসের ভারত, এই তো মোদিরাজ। চাইনি, চাই না, চাই ইসরোর ভারত। নানা ভাষা, নানা জাতি, নানা মতের বিজ্ঞানকেন্দ্র। যেখানে একাগ্রতা আর নিষ্ঠায় অস্তিত্ব খোঁজে তসিকুল বা অনুজ, বুলবুল বা খুসবু, সায়ন বা রৌশন আলি! আজও জমিতে মাঠেঘাটে, কলকারখানায় গায়ে গা ঘসে ঘামে গাম মেশানো হরিদাস বা বদরুর সন্তান ওরা। চেতনার চর্চায় ওরাই গড়েছে ইসরো নামের এক বিচিত্র ভারত।
Comments